BAMCEF UNIFICATION CONFERENCE 7

Published on 10 Mar 2013 ALL INDIA BAMCEF UNIFICATION CONFERENCE HELD AT Dr.B. R. AMBEDKAR BHAVAN,DADAR,MUMBAI ON 2ND AND 3RD MARCH 2013. Mr.PALASH BISWAS (JOURNALIST -KOLKATA) DELIVERING HER SPEECH. http://www.youtube.com/watch?v=oLL-n6MrcoM http://youtu.be/oLL-n6MrcoM

Monday, January 17, 2011

শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:৫৭

শেয়ার করুনঃ
000

তার সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন, "কি পশ্চিম বাংলা কি বাংলাদেশ সবটা মেলালে তিনি শ্রেষ্ঠ লেখক।" লিখেছেন, "ইলিয়াস-এর পায়ের নখের তুল্য কিছু লিখতে পারলে আমি ধন্য হতাম।" আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলাদেশী কথা সাহিত্যিক। একজন স্বল্পপ্রজ লেখক। দু'টি মাত্র উপন্যাস - চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৭) ও খোয়াবনামা (১৯৯৬) বাংলা সাহিত্যে তাঁর অক্ষয় আসনটি নির্মাণ করে দিয়েছে। 
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৯৪৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি গোটিয়া জেলার গাইবান্ধা গ্রামে মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়। ম্যাট্রিক পাস করেন বগুড়া জিলা স্কুল থেকে (১৯৫৮) এবং ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে (১৯৬০) । এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন (১৯৬৪)। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পুরস্কার পেয়েছেন অনেকগুলো। উল্লেখযোগ্য হল বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩) এবং একুশে পদক (মরণোত্তর) (১৯৯৯)।
রাজনীতি আমাদের জীবনের একটি প্রধান নিয়ামক হলেও আমাদের সাহিত্যে সরাসরি রাজনৈতিক প্রসঙ্গিক প্রসঙ্গ ব্যাপকভাবে বিবেচিত হয়নি। রাজনীতির সঙ্গে লেখকরা সবসময়ই নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখেছেন। ইলিয়াসই প্রথম এতটা সার্থক শিল্পসম্মতভাবে প্রধান দুটি আন্দোলনকে তার দুই উপন্যাসে ধারন করলেন। চিলেকাঠার সেপাই উপন্যাসে তিনি উপজীব্য করেছেন এ দেশের রাজনীতির পাকিস্তান পর্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ঊনসত্তরের গণআন্দোলনকে। এটি অবলম্বনে পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার শেষ ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস খোয়াবনামার মূল প্রসঙ্গ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি জনপদে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রভাব। এই উপন্যাসের জন্য তিনি পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার।

 

সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা 


http://www.somewhereinblog.net/blog/Lighthousebdblog/28749594

স্মরণচিলেকোঠার সেপাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

বাহুল্য কখনো কখনো গুণগতমানকে বদলে দেয় অথবা প্রসঙ্গ ছাপিয়ে অপ্রসঙ্গকে করে তোলে প্রধান বিষয়। খুব সচেতন ছিলেন বলেই বোধ হয় আর দশজন লেখকের মতো তাঁর বইয়ের তালিকায় শত শত নাম যোগ হয়নি। সমাজের সব বিপত্তি নিয়ে সচেতন হলেও সব কিছু নিয়েই লেখেননি একতরফা নিজের বক্তব্য। কিন্তু যে দুটি বইয়ের নাম যোগ হয়েছে, তা-ই যথেষ্ট সব প্রজন্মের পাঠকের কাছে পেঁৗছে যাওয়ার জন্য। চিলেকোঠার সেপাই আর খোয়াবনামা। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সারির লেখকদের মধ্যে তাই সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর পাশাপাশি যে নামটি সমান যোজনা নিয়ে উঠে আসে, সেটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এক পুরুষের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর তা থেকে তৈরি নানা সামাজিক অমীমাংসিত সংকট নিয়ে তাঁর গল্পের শুরু। ব্যক্তিকেন্দ্রিক জটিলতার বর্ণনার মধ্য দিয়ে চিলেকোঠার সেপাইতে নিয়ে এসেছেন মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। 'আইয়ুব শাহী জুলুম শাহী-ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক' স্লোগান মিছিলের নামে উচ্চারিত হয়েছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসেরই কণ্ঠ থেকে। উপন্যাসের মূল চরিত্র ওসমানের সঙ্গে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে দরিদ্র-নিঃস্ব কিন্তু তেজোদীপ্ত এক ব্যতিক্রমী চরিত্র হাড্ডি খিজিরকে পরিচয় করিয়েছেন পাঠকের সঙ্গে। ওসমানের বিচ্ছিন্নতা আর আত্মপ্রেমের চার দেয়ালের বর্ণনায় এঁকেছেন ব্যক্তিমানুষের একান্ত কিছু সংকটের দৃশ্য। অর্ধশত বছর পরও উপেক্ষিত, কিন্তু এই সংকটের অস্তিত্ব আজও প্রকট। স্বপ্ন দেখতেন একদিন এমন চিলেকোঠা ছেড়ে সত্যিই বেরিয়ে পড়বে মানুষ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্ম গাইবান্ধায় ১৯৪৩ সালে। পড়েছেন বগুড়া জেলা স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ভক্ত ছিলেন মিগুয়েল সার্ভান্তেসের লেখা 'দোন কিহোতে' উপন্যাসের। আর এর প্রভাবও পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। শেষের দিকে লেখা খোয়াবনামা এই উপমহাদেশের বিভক্তিপূর্ব সময়ে ঘটে যাওয়া তেভাগা আন্দোলনের ঘটনাকে উপজীব্য করে। শরণার্থীদের মানবেতর জীবনের কথা বলেছেন তিনি। প্রকাশিত ছোটগল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অন্যঘরে অন্যস্বর, খোয়ারী, দুধভাতে উৎপাত ও দোজখের ওম। সংস্কৃতি ভাঙা সেতু তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। অনেকের চেয়ে ভিন্ন তিনি নাম নির্বাচনে, যা লেখার প্রতি পাঠককে প্রথম আকর্ষণ করে। তাঁর লেখায় থাকা রঙ্গ, ব্যঙ্গ, ব্যক্তিভাবনা, রাজনীতি আর ইতিহাসের উপস্থিতি খুব কম সাহিত্যে রয়েছে। খোয়াবনামায় তিনি ম্যাজিক রিয়ালিজমের ধারা এনে বাংলা সাহিত্যে যোগ করেছেন নতুন পদ্ধতি। ব্যক্তিজীবনে সব সময় পাইপ মুখে দেওয়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি আশ্চর্য গুণ ছিল, মানুষের প্রতি মূল্যায়ন। যে সময় উঠতি লেখক আর বিজ্ঞজনদের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান, তখন তিনি তরুণদের নিয়ে দারুণ উৎসাহী। তাঁর লেখার আলোচনা ও সমালোচনা দুই-ই গ্রহণ করতেন গুরুত্ব দিয়ে। আগ্রহ ছিল অনেক অপ্রচলিত বিষয়ে। বাংলা একাডেমী, আলাওল, আনন্দ, একুশে পদকসহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তাঁর বই অনূদিত হয়েছে কয়েকটি ভাষায়। ড্রইং রুম সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা সাহিত্য রচনার পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া অনেক মৌলিক সংস্কৃতি তুলে আনার জন্যই বেঁচে থাকবেন তিনি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মৃত্যু দিনে রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম
http://www.dailykalerkantho.com/?view=details&type=gold&data=Car&pub_no=390&cat_id=2&menu_id=20&news_type_id=1&index=3&archiev=yes&arch_date=04-01-2011
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
 
 
trans
দিনটি ছিল ১৯৯৬ সালের ১৩ জানুয়ারি৷ এ দিনে মরণব্যাধি ক্যান্সার (অস্টিও সারকোমা) ধরা পড়ে তাঁর ডান পায়ে৷ একই বছরের ২০ মার্চ অস্ত্রোপাচার করে ডাক্তাররা কেটে ফেলেন তাঁর সম্পূর্ণ ডান পা৷ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যখন তিনি প্রহর গুণছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর--যখন এই সুন্দর পৃথিবীকে চিরবিদায় জানাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি চোখ বুঁজে--যখন প্রিয় সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটি বারবার ভিজে উঠছিল গোপন কান্নায়--ঠিক তখনই কলকাতা থেকে সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ভূষিত করা হলো আনন্দবাজার পুরস্কারে৷ নিশ্চিত মৃত্যুর কঠিন বাহুবন্ধনে থেকেও যিনি এ পুরস্কার গ্রহণে প্রথমে অস্বীকৃতি জানান, তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস৷ পূঁজিবাদ তথা প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনোভাবের কারণেই তিনি এ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন৷ কেননা, জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন সমাজবাদী চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী একজন রাজনীতি সচেতন সাংস্কৃতিক কর্মী৷ লেখক, শিল্পী ও সমাজকর্মীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে তিনি ছিলেন সব সময় সোচ্চার৷ আনন্দবাজার পাবলিকেসন্স লিমিটেডের দেয়া পুরস্কার তাই ইলিয়াস সচেতনভাবেই গ্রহণ করতে চাননি৷ অবশ্য পরে চিকিত্‍সা খরচের কথা ভেবে, পুরস্কার কমিটির সদস্য ড. আনিসুজ্জামানসহ বন্ধু-বান্ধবদের অনুরোধে তিনি এ পুরস্কার গ্রহণ করেন৷

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস শুধু বাংলাদেশের কথাসাহিত্যেই নয়, সমগ্র বাংলাসাহিত্যেরই একজন অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিক৷ তিনি কখনোই লেখার সংখ্যা বৃদ্ধিতে মনোযোগী ছিলেন না৷ ভিন্ন আঙ্গিক ও প্রকরণে মনোযোগী এ লেখক তাই খুব বেশি লেখেননি জীবনে৷ কিন্তু যা লিখেছেন শিল্প-বিচারে তা এখনও বিশ্বমানের, এমনটিই মনে করেন সাহিত্যের বিদগ্ধ সমালোচকেরা৷ জীবনের গভীরতম শাঁস পর্যনত্ম অশেষ কৌতূহল নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে শিল্পকর্মে তা দ্বিধাহীন প্রকাশ করার বিরল ক্ষমতা যাঁর লেখায় পাওয়া যায় তিনিই কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস৷ যদিও প্রকৃতি তাঁকে এই বিশ্ব পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধির জন্য বেশি সময় দেয়নি৷ হয়ত সেজন্যই এই নাজুক ও স্বল্পায়ু সময়ে তিনি মর্মভেদী দৃষ্টিকে শাণিত করে দেখেছেন তাঁর চেনা বিশ্বকে৷ যাপিতজীবনের বাহিরেও যে আরো কিছু দেখবার ও বুঝবার দিক আছে তা আমরা ইলিয়াসের গল্প ও উপন্যাস পড়ে আবিষ্কার করতে পারি৷ তাঁর লেখায় আমরা পাই গভীর জীবনবোধ ও তীক্ষ্ণ হাস্যকৌতুকের সাক্ষাত্‍৷ সাধারণ নিম্নবর্ণের মানুষের মুখের ভাষাও তাঁর রচনায় মর্যাদা পায়৷ লেখায় তিনি শুধু গল্প বলেন না, পাঠককে ভেতর থেকে নাড়া দেন, ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়েও রাখেন৷

একটি প্রবন্ধের বই, ৫টি গল্পগ্রন্থ ও দুটি কালজয়ী উপন্যাস ছাড়াও ইলিয়াস আমাদের জন্য রেখে গেছেন বেশ কিছু প্রবন্ধ, সাক্ষাত্‍কার, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু- বান্ধব, ও পাঠক-সম্পাদকের কাছে লেখা চিঠিপত্র, শখ করে লেখা কিছু কবিতা এবং স্কুল পাঠ্যবইয়ের জন্য লেখা চিরায়ত সাহিত্যের রি-টোলড গল্প৷ এ সব রচনায় তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি স্ব-মহিমায় ভাস্বর৷ তাঁর লেখা প্রবন্ধে তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা ও সামঞ্জস্য এবং বিশ্লেষণী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়৷

বর্তমান গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার গোটিয়া গ্রামে মাতামহের বাড়িতে ১৯৪৩ সালের ১২ ফেবু্রয়ারি এ প্রতিভাবান লেখকের জন্ম৷ বাবা-মা তাঁকে আদর করে ডাকতেন মঞ্জু৷ পুরো নাম আখতারম্নজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস৷ মা মরিয়ম ইলিয়াস ও বাবা বিএম ইলিয়াসের প্রথম সন্তান তিনি৷ মা ছিলেন গৃহিণী৷ বাবা ছিলেন বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক৷ শিক্ষকতার পাশাপাশি ইলিয়াসের বাবা রাজনীতি করতেন৷ ইলিয়াসের জন্মের সময় তিনি ছিলেন পূর্ববাংলা মুসলিম লিগের বগুড়া জেলার সেক্রেটারি৷ ইলিয়াসের পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানার চন্দনবাইশা গ্রামে৷ সেখান থেকে এসে ইলিয়াসের দাদা বাড়ি করেন বগুড়া শহরের উপকন্ঠে করতোয়া নদীর তীরে, গ্রামের নাম নারুলি৷ নারুলি গ্রামেই কাটে ইলিয়াসের শৈশবের প্রথম চারটি বছর৷ তাঁর ছোট তিন ভাইয়ের নাম শহীদুজ্জামান ইলিয়াস, নূরুজ্জামান ইলিয়াস ও খালেকুজ্জামান ইলিয়াস৷ ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ইলিয়াসের বাবা বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং দেশ বিভাগের দু' বছর পর প্রাদেশিক আইন পরিষদের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি নিযুক্ত হন৷ এ সময় ইলিয়াসের বাবা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন৷ পিতার সক্রিয় রাজনীতির সূত্রে ইলিয়াসের শৈশব কাটে একটি রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ৷ ইলিয়াসের বাবা রাজনীতি করতেন বলে তাঁদের বাড়িতে অনেক লোকের আসা-যাওয়া ছিল৷ এঁদেরকে তাঁরা চাচা বলে ডাকতেন৷ এ রকমই একজন ছিলেন সিদ্দিক চাচা৷ ১৯৪৯ সালে সেই সিদ্দিক চাচাকে দিয়েই ইলিয়াসদের দুই ভাইকে ঢাকার একটি স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন তাঁর মা৷ সিদ্দিক চাচা তাঁদের ভর্তি করিয়েই খালাস৷ পরের দিন তাঁদেরকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার ভার নিলেন আর এক চাচা ৷ কিন্তু তিনি ভাল করে জানতেন না তাঁদেরকে কোন স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে৷ ওই এলাকায় তখন বহু স্কুল ছিল৷ নওয়াবপুর প্রিয়নাথ স্কুল ছাড়া অন্য সব স্কুলই লক্ষ্মীবাজার এলাকায়৷ সেই চাচা ইলিয়াসকে আর তাঁর ভাই শহীদুজ্জামানকে নিয়ে একটার পর একটা স্কুলে খোঁজ নিতে শুরু করলেন৷ শেষ পর্যন্ত সেন্ট ফ্যান্সিস জেভিয়ার্স স্কুলের মেমসাহেবরা খাতাপত্রে তাঁদের নাম খুঁজে পেলেন৷

১৯৫০ সালে এ স্কুলটি ছেড়ে ঢাকার কেএল জুবিলি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন ইলিয়াস৷ তৃতীয় শ্রেণীতে না পড়েই ১৯৫১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি৷ ১৯৫৪ সালে তাঁর পরিবার ঢাকা থেকে বগুড়াতে চলে যায়৷ তখন আবার ইলিয়াসকে স্কুল পরিবর্তন করতে হয়৷ বগুড়াতে গিয়ে তিনি ভর্তি হন বগুড়া জেলা স্কুলে৷ ১৯৫৮ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করার পর আবার ঢাকায় চলে আসেন ইলিয়াস এবং ভর্তি হন ঢাকা কলেজে ৷ তখন পরিবারের সবাই বগুড়াতে থাকার কারণে ঢাকা কলেজের নর্থ ছাত্রাবাসে থাকতেন তিনি৷ ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি৷ উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বে পড়ার আগ্রহ ছিল ইলিয়াসের৷ কিন্তু সে বছর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তুপক্ষ সমাজতত্ত্বে কোনো ছাত্র ভর্তি করলেন না৷ ফলে বাধ্য হয়ে তাঁকে ভর্তি হতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে৷ থাকতেন ফজলুল হক মুসলিম ছাত্রাবাসে৷ ১৯৬৪ সালে ইলিয়াস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ পাস করেন৷

১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে ইলিয়াস প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে৷ অবশ্য এর আগে যোগ দিয়েছিলেন করটিয়া সা'দত কলেজে৷ কিন্ত কর্তুপক্ষের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় দু, তিন দিন পর চাকরিটি ছেড়ে দেন তিনি ৷ ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করার পর সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে তাঁর উপরও বাকশালে যোগ দেয়ার চাপ পড়ে৷ কিন্তু তিনি বাকশালে যোগ দেননি৷ ১৯৮৪ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান৷ ১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে ইলিয়াস প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক হিসেবে যোগ দেন এবং ডিসেম্বরে সরকারি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন৷ এরপর ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যাপক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন৷ বিয়ে করেন ১৯৭৩ সালে, স্ত্রীর নাম সুরাইয়া৷ ডাকনাম তুতুল৷ স্ত্রী তুতুলও ছিলেন পেশায় একজন শিক্ষিকা৷ বিয়ের পর তুতুল সিরাজগঞ্জের মহিলা কলেজ থেকে চাকরি ছেড়ে ইলিয়াসের কাছে ঢাকায় চলে আসেন৷ ১৯৭৪ সালে জন্ম নেয় তাঁদের প্রথম সন্তান আন্দালিব৷

শিক্ষক হিসেবে ইলিয়াস ছিলেন খুবই জনপ্রিয়৷ ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকসুলভ দূরত্ব ছিল না তাঁর একটুও৷ ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতেন তিনি৷ অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন ক্লাস নিতে পারেননি, তাই কলকাতা থেকে ফিরে ক্রাচে ভর করেই সপ্তাহে দুই তিন দিন যেতেন ঢাকা কলেজে৷ ক্রাচে ভর করে কলেজের উঁচুসিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে রীতিমত ঘেমে যেতেন তিনি৷ কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর কথা ভেবে বাংলা বিভাগকে নিচের তলায় নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইলিয়াস রাজি হননি তাতে, কারণ এতে নাকি খারাপ নজির সৃষ্টি হবে৷ এরই মধ্যে একদিন বাথরুমে পড়ে গিয়ে ডান হাতটা কাঁধের কাছে স্থানচ্যুত হয়ে গেল, তখন আর ক্রাচে ভর করেও হাঁটতে পারতেন না ইলিয়াস৷ তবুও ক্লাস নেয়া থেকে বিরত হননি তিনি৷ তাঁর চাওয়া অনুযায়ী তখন বাসার মধ্যেই ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ ছাত্ররা তাঁর বাসায় যেতেন, তিনি হুইল চেয়ারে বসে ক্লাস নিতেন৷ ছাত্রদের উদ্দেশে উচ্চকন্ঠে দু' তিন ঘন্টা লেকচার দিয়ে ক্লানত্ম হয়ে পড়তেন৷ কারো কথাই শুনতেন না তিনি৷ বলতেন, 'ছাত্রদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, বেশি বেশি ক্লাস নিয়ে তাদের এই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে হবে'৷

স্কুলে পড়ার সময় থেকেই প্রচুর পড়ার নেশা ছিল ইলিয়াসের৷ আর লেখালেখিতে হাতেখড়ি হয় স্কুলে পড়ার সময়ই৷ এসময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত সত্যযুগও আজাদ পত্রিকায় ছোটদের পাতায় তাঁর লেখা ছাপা হতো৷ দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় সওগাত এ ইলিয়াসের প্রথম ছোটগল্প ছাপা হয়৷ ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজে পড়ার সময় অবিরাম গল্প লিখতেন এবং বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতেন৷ পাঠানো গল্পের অধিকাংশই ফেরত আসত৷ ছাপা হতো দু' একটা৷ ১৯৬১ সালে চিকেন পক্সে আক্রান্ত হলে বেশ কিছুদিন তাঁকে থাকতে হয়েছিল মিডফোর্ড হাসপাতালে৷ হাসপাতালের অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে অতন্দ্রনামের একটি গল্প লেখেন ৷ ১৯৬৪ সালে তিনি সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা স্বাক্ষর এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷ এ বছরই আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত সাম্প্রতিক ধারার গল্পনামক একটি গ্রন্থে ইলিয়াসের স্বগত মৃত্যুর পটভূমি নামে একটি গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়৷ ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে লিটল ম্যাগাজিন আসন্নতে চিলেকোঠায়নামে তাঁর একটি গল্প প্রকাশিত হয়৷ ১৯৭৫ সালে চিলেকোঠায় নামে তাঁর প্রথম উপন্যাস দৈনিক সংবাদএর সাহিত্য পাতায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা শুরু হয়৷ কিন্তু ওই সময় সরকার পরিবর্তন হওয়ায় সংবাদ কর্তৃপক্ষ উপন্যাসটি প্রকাশ বন্ধ করে দেয়৷ তখন ইলিয়াস সংবাদ কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, 'পাঠকরা এটাকে লেখকের দায়িত্বহীনতা ভাবতে পারে, আপনারা যে ছাপতে পারছেন না সেটা লিখে দিন৷' ওরা তা লিখে দিয়েছিল৷ ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় ইলিয়াসের প্রথম গল্পগ্রন্থ অন্য ঘরে অন্য স্বর৷ তিনি গ্রন্থটির নামকরণ করেন ট্রুম্যান কেপোটের আদার রুম আদার ভয়েস্ নামে উপন্যাসটির নাম অবলম্বনে ৷ প্রচুর প্রশংসা পায় বইটি৷ ওই বছরের জুলাই মাসে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সংবত শীর্ষক একটি লিটল ম্যাগাজিনে গল্পকার হাসান আজিজুল হক গ্রন্থটির সমালোচনা লেখেন৷ এছাড়া মাহবুবুল আলম, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, মুনতাসীর মামুন, আবুল হাসানাত এবং মাজহারুল ইসলাম বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় গ্রন্থটির উপর আলোচনা করেন৷ সৈয়দ শামসুল হকও টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে তখন বইটির প্রশংসা করেন৷ ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় তাঁর প্রথম উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাইধারাবাহিকভাবে ছাপা শুরু হয়৷ ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে সাপ্তাহিক রোববার-এ চিলেকোঠার সেপাই ছাপা শেষ হয়৷ ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে রাজশাহীর তরঙ্গ প্রকাশনী হতে তার গল্পগ্রন্থ খোঁয়ারি প্রকাশিত হয় ৷ ১৯৮৫ সালে দুধ ভাতে উত্‍পাত শিরোনামে তাঁর আরেকটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়৷ ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড হতে বই আকারে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই ৷ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠক মহলে বেশ সাড়া পড়ে ৷ তাঁর আরেকটি গল্পগ্রন্থ দোজখের ওম প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে৷ ১৯৯২ সালে এবছরই ইলিয়াসকে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে এজাজ ইউসুফ সম্পাদিত লিরিকসাহিত্য পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা বের হয়৷ ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে ইলিয়াসের পঞ্চাশ বছরপূর্তি উপলক্ষে কলকাতার একুশে প্রকাশনী প্রকাশ করে তাঁর একটি গল্প সংগ্রহ গ্রন্থ৷ এপ্রিল মাসে কলকাতার বাংলাদেশ মিশন কর্তৃক আয়োজিত গ্রন্থমেলায় অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে তিনি কলকাতা সফরে যান৷ এ বছর জুন মাসে কলকাতার প্রতিভাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসটি৷ ১৯৯৪ সালে দৈনিক জনকন্ঠ-এর সাহিত্যপাতায় ইলিয়াসের উপন্যাস খোয়াবনামা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে শুরু হয়৷ যদিও পুরো উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার আগে জনকন্ঠকর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক কারণে খোয়াবনামা ছাপা বন্ধ করে দেয়৷

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ইলিয়াস পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন৷ সে সময় তাঁর বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন তিনি৷ এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে ইলিয়াস তাঁর জগন্নাথ কলেজের সহকর্মী কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর বাসায় ভাড়া থাকতেন৷ আটষট্টি-ঊনসত্তরের গণআন্দোলন একনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন ইলিয়াস ৷ প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক মিটিংয়ে তিনি ছিলেন মনোযোগী শ্রোতা৷ বিশেষত মওলানা ভাসানীর প্রায় প্রতিটি মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন৷ আর বিভিন্ন মিছিলেও যেতেন তিনি৷ সেই সময় চীনের তত্‍কালীন সাংস্কৃতিক বিপ্লব এবং পরে ভারতের নকশাল বাড়ি আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ অনুধাবন করেছেন তিনি গভীর মনোযোগ সহকারে৷ ১৯৮৪ সালে ইলিয়াসবাংলাদেশ লেখক শিবিরেযোগ দেন এবং লেখক শিল্পীদের অধিকারপ্রতিষ্ঠা আন্দোলনে আমৃতু্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন৷ ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় যখন চারদিকে বন্যার্তদের হাহাকার তখন তিনি সরাসরি ত্রাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন৷ ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবিরের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় তিন দিনব্যাপী জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন৷ এ সম্মেলনেও মূখ্যভূমিকা পালন করেন তিনি৷ ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে লেখক- শিল্পীদের উপর ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের আক্রমণ ও ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের চক্রান্তের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান, নেতৃত্ব দেনবাংলাদেশ লেখক শিবিরের

১৯৭৭ সাল ছিল ইলিয়াসের জন্য স্মরণীয়৷ কারণ জীবনের প্রথম পুরস্কার হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি এই সালে৷ বাংলাদেশ লেখক শিবির সংঘ তাঁকে এই পুরস্কারে ভূষিত করেন ৷ এরপর ১৯৮৩ সালে ইলিয়াস বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন৷ ১৯৮৭ সালে তিনি আলাওল সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন৷ ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে খোয়াবনামার জন্য পান প্রফুল্ল কুমার সরকার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার এবং সাদাত আলী আকন্দ পুরস্কার৷ এবছর কাজী মাহবুবউল্লাহ স্বর্ণপদক নামে আরেকটি পুরষ্কার পান তিনি ৷

আড্ডা দিতে খুব পছন্দ করতেন ইলিয়াস৷ ঢাকা কলেজের নর্থ হোস্টেলে থাকার সময় হোস্টেলের রুমে বসেই ইলিয়াস আড্ডা দিতেন বন্ধু শহিদুর রহমান ও আব্দুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে৷ আড্ডায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা হতো গল্প লেখার বিভিন্ন প্রকরণ ও ভাষা বিষয়ে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও আড্ডা ও সাহিত্যচর্চা আর সাহিত্যবিষয়ক পড়াশোনা চালাতেন সমানভাবে৷ তখন শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে আড্ডা দিতেন ইলিয়াস৷ তাঁর আড্ডার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন মুহম্মদ মুজাদ্দেদ, চিত্তরঞ্জন হালদার, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, ইকবাল রুমি ও আসাদ চৌধুরী৷ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার পাশাপাশি তখন ইলিয়াস ব্রিটিশ কাউন্সিল ও পাবলিক লাইব্রেরিতে নিয়মিত সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করতেন৷ ১৯৬৫ সালের দিকে ইলিয়াস তদানীন্তন জিন্নাহ এভেনু্যর রেস্টুরেন্ট রেকস্ ও নবাবপুরের হোটেল আরজু-তে আড্ডা দিতেন৷ এছাড়াও আড্ডা দিতেন বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিংও কাপ্তান বাজারের নাইল ভ্যালিরেস্টুরেন্টে ৷ এসব স্থানে তাঁর আড্ডার সঙ্গী ছিলেন খালেদ চৌধুরী, বুড়ো ভাই (মুশাররফ রসুল), শহীদ কাদরী, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, নির্মলেন্দু গুণ, বিপ্লব দাশ, রণজিত্‍ পাল চৌধুরী, জামাল খান, মোহাম্মদ খসরু, ইয়াসিন আমিন, রফিক আজাদ, প্রশান্ত ঘোষাল, মাজহারুল ইসলাম,ও মাহবুবুল আলমসহ আরো অনেকেই৷

১৯৯৫ সালের ফেবু্রয়ারি মাসে স্ত্রীর চিকিত্‍সার উদ্দেশ্যে তিনি সস্ত্রীক কলকাতায় যান এবং শান্তিনিকেতন ভ্রমণ করেন৷ অক্টোবরে মাকে হারান ইলিয়াস৷ মায়ের মৃত্যুর পর পরই ইলিয়াস অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ পায়ের তীব্র ব্যথা উপেক্ষা করে তখন দিনরাত খোয়াবনামা লিখছিলেন৷ ক্যান্সারকে বাত ভেবে ডাক্তাররা তখন ভুল চিকিত্‍সা দিচ্ছিলেন ইলিয়াসকে৷ প্রচন্ড পায়ের ব্যথা নিয়েই তিনি খোয়াবনামা উপন্যাসটি লেখা শেষ করেন ৩১ ডিসেম্বর৷ ১৯৯৬ সালে ১৩ জানুয়ারি তাঁর পায়ের হাড়ে ধরা পড়ে ক্যান্সার৷ ক্যান্সারের কারণে ২০ মার্চ তাঁর ডান পা সম্পূর্ণ কেটে ফেলা হয়৷ এবছর বই আকারে প্রকাশিত হয় তাঁর কালজয়ী উপন্যাস খোয়াবনামা৷ ২৭ এপ্রিল কলকাতা থেকে দেশে ফেরেন ইলিয়াস৷

১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি৷ পাখিডাকা সিগ্ধ ভোর৷ ঢাকার মালিবাগ কমিউনিটি হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে কালজয়ী এ লেখক পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান৷ তাঁর মৃত্যুর পর তত্‍কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজিমপুরে তাঁর বাসভবনে গিয়ে শোক প্রকাশ করেন৷ ওই দিন বিকালেই ইলিয়াসের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বগুড়ার জ্বলেশ্বরীতলার বাসায়৷ তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী মৃত্যুর পরের দিন বগুড়া শহরের দক্ষিণ বগুড়া গোরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়৷ সেদিন থেকে বাংলা সাহিত্যের মনোযোগী পাঠকরা হারান একজন জীবনঘনিষ্ঠ কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে৷ নিজের সম্পর্কে যিনি বলতেন,' আমি চব্বিশ ঘন্টার লেখক...'৷

একনজরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

নাম: আখতারম্নজ্জামান ইলিয়াস:
মা: মরিয়ম ইলিয়াস 
বাবা: বিএম ইলিয়াস
জন্ম: ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩৷

পড়াশুনা:
মাধ্যমিক: ১৯৫৮ সাল, বগুড়া জিলা স্কুল
উচ্চমাধ্যমিক: ১৯৬০ সাল, ঢাকা কলেজ
এম এ: ১৯৬৪ সাল (বাংলা সাহিত্য), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কর্মজীবন
১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে ইলিয়াস প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে৷ অবশ্য এর আগে যোগ দিয়েছিলেন করটিয়া সা'দত কলেজে৷ যদিও দু' তিন দিন পর চাকরিটি ছেড়ে দেন কতর্ৃপক্ষের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিলেন না বলে৷১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করার পর সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে তাঁর উপরও বাকশালে যোগ দেয়ার চাপ পড়ে৷ কিন্তু তিনি বাকশালে যোগ দেননি৷ ১৯৮৪ জগন্নাথ কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান৷ ১৯৮৭'র জানুয়ারিতে ইলিয়াস প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হিসেবে যোগ দেন এবং ডিসেম্বরে সরকারি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন৷ ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা কলেজে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন৷

পুরস্কার
১৯৭৭ সালে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হন ৷ বাংলাদেশ লেখক শিবির সংঘ তাঁকে এই পুরস্কারে ভূষিত করেন ৷ ১৯৮৩ সালে ইলিয়াস বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন৷ ১৯৮৭ সালে তিনি আলাওল সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন৷ ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে মাসে খোয়াবনামার জন্য পান প্রফুলস্ন কুমার সরকার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার এবং 'সাদাত আলী আকন্দ' পুরস্কার৷ এবছর 'কাজী মাহবুবউলস্নাহ' স্বর্ণপদক নামে আরেকটি পুরষ্কার পান তিনি ৷

প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ:
অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারি, দুধভাতে উত্‍পাত, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল ( মৃত্যুর পরে প্রকাশিত), দোজখের ওম৷
প্রবন্ধের বই: সংস্কৃতির ভাঙা সেতু (মৃত্যুর পরে প্রকাশিত)
উপন্যাস: চিলেকোঠার সেপাই, খোয়াবনামা

মৃত্যু: ৪ জানুয়ারি ১৯৯৭৷

তথ্যসূত্র: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সমগ্র, দ্বিতীয় খন্ড, মওলা ব্রাদার্স আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্মারকগ্রন্থ, ফিরে দেখা সারাজীবন, দ্বিতীয় খন্ড ( সম্পাদক-মুজিবুল কবীর ও মাহবুব কামরান) ও খালেকুজ্জামান ইলিয়াস

লেখক : আপন মাহমুদ

 

গল্পনির্মাতা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস...ফজলুল হক সৈকত
গল্পনির্মাতা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্ম ১৯৪৩ সালের ৪ জানুয়ারি। তিনি ১৯৯৭-এ পরলোকগমণ করেন। বাংলাদেশের ছোটগল্পের রূপান্তর আর ক্রম-উৎকর্ষের প্রবাহটিকে নতুন রীতি-কৌশলের অভিযোজনায়, শব্দ ও বাক্য প্রয়োগে, প্রকাশভঙ্গিতে, বিষয়ের নিবিড় উপস্থাপনায়, গল্প-কাঠামো নির্মাণে আর আত্মমগ্নচেতনারু পরাবাস্তব প্রকাশে কৃতি ছোটগল্পকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্বকে মনস্তত্ত্বের জটিল রেখায় বিশ্লেষণে তিনি দারুণ দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। তার সৃষ্ট চরিত্র অনন্যতা পেয়েছে জন্মসূত্রে এবং পরিবেশগতভাবে পাওয়া ভাষা-প্রয়োগের অকৃত্রিমতায়। গল্পের চরিত্রগুলোকে কাহিনীর ঠিক ঠিক জায়গায় দাঁড় করিয়ে উপযুক্ত ভাষায় কথা বলানোর কৃতিত্ব, যে শব্দ বা বাক্য আমরা সাধারণত সামাজিকভাবে কৃত্রিম জীবনাচারে উচ্চারণ করতে বিব্রত হই, সেসব শব্দ-বাক্যের অনায়াস-প্রকাশ ইলিয়াসের গল্পের প্রধান শক্তি। প্রসঙ্গত, বাংলা সাহিত্যের আরেক গল্পকারের ভাষা-প্রয়োগ বিষয়ক একটি মন্তব্য এখানে উদ্ধৃত করছি: 
'ভাষার প্রাণবন্ততার জন্য যেমন সংস্কৃত শব্দের প্রয়োজন আছে, তেমনি slang শব্দের প্রয়োজন আছে। উচ্চভাব প্রকাশের গদ্যে slang সুষ্ঠু প্রকাশ দিতে পারে।' (সুবোধ ঘোষ, ঝিনুক কুড়িয়ে মুক্তো, দ্বিতীয় প্রকাশ জানুয়ারি ১৯৮৯,কলকাতা)
উপর্যুক্ত মন্তব্যটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পভাষা বিষয়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও যথার্থ। প্রকৃতঅর্থে, তিনি মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি থেকে অবতরণ করে নিম্নকোটির মানুষের মধ্যে গিয়ে হাজির হয়েছেন, প্রচলিত সাহিত্যভাষা ত্যাগ করে slang, চলতি দেহাতি শব্দ, আঞ্চলিক বা শহুরে গলির শব্দ, গালিগালাজ, মুদ্রাদোষ, সবকিছুর মিশ্রণে ভেঙে ফেলেছেন তথাকথিত আদর্শ সাহিত্যিকভাষা ও রুচি। দৃষ্টান্ত :
পুলিসের বাপে আছিলো বে তোতলাচোদা। দেখলি না লম্বা চুল, জুলফিআলা মস্তানগুলি হালায় ফাইব ফিফটি ফাইব মারতাছে। হ্যারা পুলিসের বাপ লাগে, বুঝলি? হালারা ইসটুডেন।' 'ইসটুডেন? ইসটুডেন ক্কি করবো?' তরে না একখানা চটকানা দিয়া কলতাবাজার পাঠাইয়া দেই তো আরাম পাই, বুঝলি? ডামলালু খুব বিরক্ত হয়েছে, 'ইসটুডেন হালারা কি করবো তুমি জানো না, না? কেলাব থাইকা, হোটেল থাইকা সাহেবরা বারাইবো মাল টাইনা, হ্যারা হেই গাড়িগুলি ধইরা মালপানি কামায়, মাগীউগি পছন্দ হইলে ময়দানের মইদ্যে লইয়া হেইগুলিরে লাগায়। অহন বুঝলি বাঙ্গুচোদা, বুঝলি, দিন তো অহন হালায় ইসটুডেন গো, হালায় ইসটুডেনের মারে বাপ। (ফেরারী : অন্য ঘরে অন্য স্বর)
ব্যক্তির পারিবারিক-সামাজিক অবস্থান আর মানসিক ভ্রান্তি-বিভ্রমকে ইলিয়াস তাঁর গল্পে প্রকাশ করতে গিয়ে চরিত্রের আন্তর্ধর্ম এবং আত্মবিবৃতির ওপর নির্ভর করেছেন। কল্পনায় সাজানো মানুষের সমাজসত্যকে পরিবেশন করেছেন তার মানোবাস্তবিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে। 'উৎসব' গল্পে মানসিকবিকৃতি, দাম্পত্যজীবনের অসাড়তা আর তা থেকে শোভন-পাটাতনে উত্তরণের, আড়মোরার আওয়াজ নির্মাণ করতে গিয়ে একটি সামাজিক কৃত্রিম অনুষ্ঠান ও অন্য একটি অকৃত্রিম আপাত অসামাজিক উপভোগ্য দৃশ্যকে প্রায় পাশাপাশি দাঁড় করানোর দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে গল্পবর্ণনাকারী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে। জীবনে চলার পথে 'সোনালি ফসল' কুড়াতে ব্যর্থ এক আপাতসংকুচিত পুরুষ তার কৈশোরবন্ধুর বিবাহজনিত অভ্যর্থনা-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যায়, যোগ দিতে যায় বিবর্ণমনে ব্যাকুল-চাওয়ার ক্ষতে 'ভালো ভালো মেয়ে' দেখার আনন্দ-মাখা প্রলেপ বুলানো মাতোয়ারা সান্ধ্যবাসরে। উচ্চবিত্তের অনুষ্ঠান-সভার আলো-আঁধারি আর নারীপুরুষের কথালাপ-নিবিড় চলাচলের অন্তরালে মধ্যবয়সী অসুখী-ক্লান্ত, এই পুরুষ খুঁজতে থাকে মেয়েমানুষের গন্ধ আর নির্ঘুম রাত্রিযাপনের ছায়াসঙ্গীর কোমল-অস্পষ্ট সান্নিধ্য। সন্ধ্যায় মেয়েমানুষ দেখার সুখ-সুখ অনুভূতি নিয়ে বিছানায় অপেক্ষারত স্ত্রীর নিরানন্দ স্পর্শ আর গভীর রাতে সিনেমা শোফেরত-পসরা বন্ধকারী অবসর নিম্নবর্গের মানুষের কুকরের রতিক্রিয়া দর্শনের ভালোলাগা অনুভবের সাথে একাত্ম হয়ে আপাতবিবশ স্ত্রীর গায়ে সুগন্ধের আকর্ষণ পেতে চাওয়ার বিচ্ছিন্ন চিত্রভাষ্যে গল্পকার তৈরি করেছেন মনোবিকলনের এক স্বপ্ন-বাস্তবের গল্পদেহ। গল্পনির্মাতার বিবরণ :
শুয়ে পড়তে পড়তে আনোয়ার আলি তার স্ত্রীর প্রশ্নমালার সংক্ষিপ্ত ও মোটামুটি সন্তোষজনক উত্তর দেয়। এখন নিয়মিত প্রাক-নিদ্রা রতিক্রিয়ার পালা। এই মেয়েটিকে অন্তত মিনিট বিশেক ভালোবাসতে হবে। ভয় হয়, সালেহা তার মূল্যবান সন্ধেবেলাটা তছনছ না করে ফেলে। তবে ভালো ভালো মেয়ে দ্যাখা গেছে বহু, সুখ তো আজ ওদের নিয়ে, সালেহা উপলক্ষ মাত্র।
অস্তিত্বভাবনা আর নিয়তির অমোঘ বিধানের অনতিক্রম্য সত্যাসত্য উপস্থাপনের জন্য ইলিয়াস আশ্রয় করেছেন লৌকিকতা-অলৌকিকতার বিষয়াদির ওপর; মানুষের সীমাবদ্ধতা আঁকতে গিয়ে পরিবেশন করেছেন সৃষ্টিরহস্যের অসীমতার আবছাআলো। ইলিয়াসের 'দোজখের ওম' স্বপ্ন-বাস্তবের মায়াজালে বাঁধা, প্রকৃতির অকৃত্রিমতায় ঝুলে-থাকা মেয়াদ-উত্তীর্ণ মানুষের গল্প। বেঁচে থাকার মতো স্বাভাবিক শারীরিক-মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলা অধিক বয়সের মানুষ সামাজিক-পারিবারিকভাবে কী রকম প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে, তার বিশ্বাসযোগ্য বাণীরূপ বর্তমান গল্পটি। কামালউদ্দিন বয়সের ভারে নুয়ে-পড়া জীবন অন্বেষণী এক অভিমানী-প্রতিবাদী পুরুষ। গল্পের দীর্ঘ পরিসরে কামালউদ্দিনের আরো দীর্ঘ যাপিতজীবনের দিনলিপি ও ভাবনাভাষ্য লেখক পরিবেশন করেছেন বিবেচনা ও উপলব্ধির বিচিত্র কৌণিকতায়। বর্ণিত বৃদ্ধের অতিক্রান্ত সময়ের প্রমাণিত সাফল্য, স্বপ্ন, মৃত্যুভাবনা আর টিকে থাকার আকুলতা এই কাহিনীর আপাত ক্যানভাস। স্বল্প-আয়নির্ভর অতিবাহিত পারিবারিক জীবন কামালউদ্দিনের। গল্পকার লিখছেন, 'ইসলামপুরের ছাতা ও খেলার সরঞ্জামের দোকানের বারান্দায় সিঙ্গার মেশিনে লুঙি, বালিশের অড় ও মশারি সেলাই করে তার জীবন কাটলো'। স্ত্রীর দেহাবসান, স্মৃতিলগ্নতা, বিবর্ণ-বিষণ্ণতা কামালউদ্দিনকে মাঝে মাঝে ক্লান্ত করলেও বাঁচবার অধিকারবোধে সে দারুণ প্রত্যয়ী। তার বাঁচবার স্বপ্ন, স্বপ্নে স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ-আলাপ, মেয়ের কাছে স্বপ্নের ব্যাপারটি গোপন রাখার চিন্তা আর শেষপর্যন্ত সত্য প্রকাশ করার বিষয়াদি গল্পকার পঠকের সামনে হাজির করেছেন বৃদ্ধের পরনির্ভরতা এবং জীবনের স্বাদ আরো খানিকটা চেখে নেবার বাসনার উপর আশ্রয় করে। কাহিনীকারের ভাষ্য :
বাবার কপালে হাত দিয়ে খোদেজা নিজেও ভয় পায়, 'ইস, ঘাইমা এক্কেরে নাহাইয়া উঠছেন। আব্বা, কি খোয়াব দেখছেন?' খোলা দরজা দিয়ে একটু একটু হাওয়া আসছিলো, কপালে ও মাথায় মেয়ের হাতের স্পর্শে কামালউদ্দিন ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন দুপুরবেলা বাপকে ভাত খাওয়াবার সময় কথায় কথায় খোদেজা সব জেনে নেয়। স্ত্রীর দৈনিক যাতায়াতের খবরটি গোপন রাখাই ভালো। আকবরের মায়ের ডাকে সাড়া দিতে না পারায় এমনি সে কুঁকড়ে আছে, এইসব ফাঁস করে সকলের সামনে জড়সড় হওয়ার দরকারটা কী? তবে কি-না সেদিন কৈমাছের ঝোল ছিলো, আলু ঝিঙা দিয়ে মাখামাখা করে রাঁধা, এক চিমটি মাছে আঠালো জিভে স্বাদটিকে আরো চটচটে করে নেওয়ার লোভে সে বলে, 'তর মায়ে আইছিলো।'
সন্তানের প্রতি স্নেহ-মমতা, তার অন্যায় অপকর্মের জন্য শাস্তি প্রদান আর শেষত পুনরায় স্নেহবশত ক্ষমা প্রদান প্রভৃতি প্রসঙ্গ পরিবেশনের জন্য গল্পকার নির্বাচন করেছেন এক বিশ্বাসযোগ্য বিবৃতিভাষ্য। অবাধ্য ছেলেকে একদিন যে মা ঘরে ঢুকতে দেয়নি, তার প্রতি দীর্ঘদিনের গোপন-লালিত কষ্টবোধ আর কাছে টানবার অভিপ্রায়কে গল্পকার তুলে ধরেছেন মরণযন্ত্রণাকাতর মায়ের, ছেলের শৈশব স্মৃতিনির্ভর, বিলাপ-প্রলাপের মোহময় মোড়কে :
আকবরের মা মরলো সপ্তাহখানেকের জ্বরে, কিন্তু ঐ ৭/৮ দিন জ্বরের ঘোরে তার মুখে আকর ছাড়া আর কথা শোনা যায় নাই। 'আকবর, বাবা, ও আব্বা, দুধ খাইবি না?' 'ও আকবরের বাপ, দেইখা যাও, তোমার পোলায় তোমার টুপি পইরা কেমুন হাসতাছে!' 'আকবর, আব্বা, আমার সোনাটা, আয়, নাহাইয়া দেই ভাত খাইয়া খেলবি, অহন আয় বাবা!' 'হায় হায়,! আকবরে আউজকা নারিন্দার মোচড়ে গেছিলো গিয়া, পোলায় কেমুন বিচ্ছু হইছে, কুনদিন গাড়ির নিচে পড়বো!'
পরিবাবেরর অনেকে গত হয়েছে, কিন্তু আপাতভাবে 'মেয়াদের ওপর দুনিয়ায় বসবাসের শাস্তি' ভোগ করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়ছে কামালউদ্দিন। তার শরীরের একাংশ পক্ষাঘাতগ্রস্তÑ নিথর; অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয় প্রস্রাব-পায়খানা-থুথুফেলা-খাবার-চলাফেরার জন্য। দুনিয়ার এই গোরআজাব থেকে সে মুক্তিও কামনা করে; তবে ইচ্ছামৃত্যু যে সাধারণ মানুষের কর্ম নয়, তাও বুঝতে অসুবিধা হয় না। নতুন-পুরনো প্রজন্মের দ্বন্দ্ব, পীরসাহেবদের কেরামতি আর প্রত্যাশিত কোনো রমণীর অবহেলা কামালউদ্দিনকে অবসন্নতায় ডুবতে থাকা মানসিক ভ্রান্তি থেকে 'সিঁধা হইয়া খাড়া'বার শক্তি সঞ্চয় করতে সাহস জোগায়। মরতে সে চায় না; বাঁচবার অধিকার কি তার নেই! মধ্যে মধ্যে মরে-যাওয়ার বাসনা জাগে কামালউদ্দিনের মনে, 'কিন্তু আল্লার কেরামতি বোঝে কে?' অবশ্য কামালউদ্দিনের এক ছোট্ট নাতনির অবস্থান ও পরিক্রমভাবনায় লেখক পাঠককে জানান দেন বৃদ্ধের নিশ্চিত মৃত্যুর খবর :
কামালউদ্দিন তার মরণের আশ্বাস পায় কেবল রুমার কাছে, নানার মৃত্যুর অনিবার্যতা সম্বন্ধে আস্থা আছে কেবল এই মেয়েটির মনেই। খোদেজার এই মেয়েটি তার ঘরে এলেই একবার বলবে, 'নানা তুমি মরলে এই ঘরে থাকুম আমি আর আপা। আমাগো ঘরে এমুন গরম!
সামাজিক-ব্যক্তিক বিচ্ছিন্নতাবোধ আর সম্পর্কনির্ভর স্নেহ মমতার বাঁধনমাধূর্য পরিবেশন করতে গিয়ে ইলিয়াস 'অন্য ঘরে অন্য স্বর' গল্পে ঘুমপ্রকাশক হাইতোলা দৃশ্যের পৌনপুনিক ব্যবহার, স্মৃতিলগ্নতা, ভাবনার তালরহিত পরিস্থিতি আর পরাবাস্তব পরিবেশ প্রয়োগ করেছেন সতর্কদৃষ্টিতে। মনের অস্থির-পরিবর্তনপ্রবণ অবস্থা নির্দেশের জন্য আছে ধ্বনি ও গন্ধের পরিবেশনা, 'ঘরের দরজা থেকে পিসীমা চলে যাওয়ার সময় চন্দনের, শশার, কলার ও কর্পূরের ঝাপশা গন্ধ প্রদীপের নাকের সামনে একবার তুড়ি বাজিয়ে পিসীমার চুলের মধ্যে ডাইভ দিয়ে পিসীমার সঙ্গেই ফিরে গেলো।' আর জাতীয় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকটকে তিনি উপস্থাপন করেছেন রঙের প্রয়োগচাতুর্যের আলোকে; রঙ-আলো-ধ্বনির আবহ তৈরির মধ্য দিয়ে। 'খোঁয়ারি' গল্পে ভ্যাপসা-ভিজে-পুরনো জীবনের সুড়সুড়ি-লাগা ঠিকঠিক অনুভূতি নির্মিতি লাভ করেছে আওয়াজ-আলো-রঙ-অন্ধকারের প্রাত্যহিক খেলার বিবরে। সুরকি-ঝরা দেওযালের ঝাপশা রঙ, 'ঘরের দেওয়ালে খিঁচিয়ে-থাকা দাঁতের গোড়ার ছ্যাতলার মতো হলুদ জ্যোৎস্না কিংবা 'উঠানকে হলদে রঙের নোংরা চাদর-পতা বিছানা' মনে করা আর টিনের চালে জল-পড়ার শব্দ অথবা জল গড়াবার ঢকঢক আওয়াজ গল্পেবর্ণিত চরিত্রগুলোর মতোই সংকুচিত করে রাখে দিনযাপনের যাবতীয পরিবৃত্ত।
'দুধভাতে উৎপাত' গল্পে সুখ-শান্তি আর প্রত্যাশার প্রতীক হিশেবে উপস্থাপিত হয়েছে দুধভাত-এর প্রসঙ্গ। একটি পরিবারের আর্থিক-অসচ্ছলতা আর কাংখিত সুখের ব্যাপারাদির আড়ালে নির্মিতি পেয়েছে দেশের-দশের ভালো থাকার বিষয়। মায়ের দুধভাত খাবার শখ বা প্রবল আশার প্রবলতা পরিবেশিত হয়েছে জাতির প্রতিপালকরূপী, স্নেহময়ী সন্তান লালনকারীর স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত-করার প্রত্যাশার রূপকে। বাংলাদেশের খাদ্য-সংকট, দারিদ্র্য আর বিপুল মানুষের অসহায় দিনযাপনের চিত্র গল্পকার পাঠকের সামনে হাজির করেন। আর নির্মাণ করেন সংকট-উত্তরণের আশাবাদ। 'নুন আনতে পান্তা ফুরায়' অবস্থা যে জাতির, তার তো কালোগরু বিক্রি করে বা বন্ধক দিয়েই ভাতের চাল কিনতে হয়, এ বাস্তবতা আমরা পাই ইলিয়াসের বর্তমান গল্পে। আবার এ জাতি যে চিরকাল অর্র্থ-কষ্টে ভুগেছে, এমনও নয়; সুখের মুখও বাঙালি অবলোকন করেছে। নিমোক্ত বর্ণনায় পাওয়া যায় সে চিত্রের আভাস :
নতুন চাল উঠলে ছেলেমেয়েদের জয়নাব একদিন দুধভাত খাওয়ায়। কসিমুদ্দিন অবশ্য তখন তিস্তাতীরের গ্রামে। উঠানে ছেলেমেয়েদের সার করে বসিয়ে জয়নাব হাত দিয়ে মুখে মুখে ভাত তুলে দেয়। দুধ দিয়ে ভাত দিয়ে কলা দিয়ে গুড় দিয়ে।
'দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো' জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন 'মামার বাড়ির আব্দার'-এর মতো কোনো স্বাভাবিক ব্যাপারও নয়। যদিও সন্তানাদি-আত্মীয়-পরিজনের, তাদের মায়ের-নিকটজনের স্বপ্ন পুরণের প্রত্যয়, বাস্তবতা-সমর্থিত; গল্পকার জানাচ্ছেন প্রাণন্ত-প্রচেষ্টা আর তৃপ্তি মিথ্যামোড়কের ইতিহাস : 
কী করি? পোলাপানেরে খালি দুধভাত খাওয়াতে চাস। কী করি? চাইলের গুড়ি জাল দিয় দিলাম!... ক্যান বৌ? চাইলের গুড়ি পোলাপানেরে কুনোদিন খাওয়াস নাই? দুধ দিছস কয়দিন? দুধের স্বাদ তর পোলাপানে জানে কি?
ইলিয়াস তাঁর গল্প-অবয়বে প্রবেশ করিয়েছেন বিষয়ানুগ মেজাজ ও মনন। বর্ণনায় রয়েছে আড়ম্বর; ডিটেইলের প্রতি আস্থা, গঠনশৈলী আর পর্যবেক্ষণভঙ্গিতে আছে বাক্চাতুর্য আর সূক্ষ হিউমার-বোধ। উপস্থাপনকৌশলে আছে অপ্রচল ভাবনা ও পরিবেশন-পরিসর। বাংলাভাষায় গল্পনির্মাণের ধারা পরিবর্তন করে আপনমনে পথ চলতে-থাকা, নতুন পথের পথ-না-চেনা পথিক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস গল্প-পরিবেশন কায়দায় সত্যি সত্যিই সেঁধিয়ে দিলেন এক শিহরণ-জাগা ভালোলাগা।
snue90@yahoo.com

নির্মাণ-বিনির্মাণের ইলিয়াস-শান্তনু কায়সার

0

বর্তমান সময়ের একটা দুঃখজনক প্রবণতা হচ্ছে, লেখককে সরাসরি পড়ার চেয়ে তাঁকে একটি বিশেষ ছকে ফেলে সেভাবে প্রথা বানিয়ে তোলা। এভাবে লেখকের একধরনের মৃত্যু ঘটে। যে লেখকেরা একসময় ছিলেন জীবন্ত ও সাম্প্রতিক, তাঁরাও এর শিকার হন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সম্পর্কেও হয়তো এ কথা কমবেশি সত্য। তাঁর মৃত্যুর পর বারো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে নবীন প্রজন্ম অবশ্যই তাঁকে পড়েছে। কিন্তু বলতে খারাপ লাগছে, তারা হয়তো ব্যতিক্রম, নিয়ম হয়েছে বা হচ্ছে, তাঁকে নিয়ে চটজলদি কিছু ধারণা তৈরি এবং তা বলার ক্ষমতা অর্জন করে নিজেকে চৌকস প্রমাণ করা। ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্কিম-মূল্যায়ন বুঝি আজও সমান বা তার চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক, 'অনেকে মূল্য দিয়া ভাল কথা কিনিয়া থাকেন', 'সস্তা খরিদের অবিরাম চেষ্টাকে মনুষ্যজীবন বলে।'
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের এই বাস্তবতায় আলাউদ্দিন মণ্ডলের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: নির্মাণে বিনির্মাণে গত একুশে ফেব্রুয়ারির বইমেলায় প্রকাশ করেছে ঢাকার মাওলা ব্রাদার্স। পাঁচটি অধ্যায়ের বাইরে রয়েছে গ্রন্থের উপসংহার, দুটি পরিশিষ্ট ও গ্রন্থপঞ্জি।
প্রথম অধ্যায় 'আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সংক্ষিপ্ত জীবনী'। এখানে লেখকের নিজের বর্ণনার সঙ্গে সমান্তরালভাবে স্বয়ং ইলিয়াসের জবানিতে তাঁর জীবনের বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত। দ্বিতীয় অধ্যায় 'রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত'-এও মোটামুটি একই নীতি অনুসৃত। এখানে ইলিয়াসের দিনপঞ্জি একটা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এই অধ্যায়ের উপসংহারে আলাউদ্দিনের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: 'আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচনায় সময় ও সমাজের প্রতিটি স্পন্দন—তার তীব্র আলোড়ন বিকার, আবার হতাশা, নৈরাশ্য সবই মনস্ক পাঠক অনুভব করেন। এবং সেই অনুভূতি মুগ্ধতা আনে না, ভাবাবিষ্টও করে না, তা পাঠককে বাংলাদেশের জলবায়ু মাটি মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর ইতিহাস সূত্রে তার আত্মপরিচয়ের সন্ধানও করে।' তৃতীয় অধ্যায় 'কথাসাহিত্যের উত্তরাধিকার ও ইলিয়াসের সমকাল'-এ তার সাহিত্য পটভূমি বিশ্লেষণ করে এর পরের অধ্যায়ে তিনি সরাসরি তাঁর 'রচনা' ও 'লেখা'য় প্রবেশ করেছেন। এখানে তিনি ধারাবাহিকভাবে তাঁর রচনাসমূহের উত্থাপন ও বিশ্লেষণ করেছেন। উপসংহারে তিনি তাঁর দুটি উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই ও খোয়াবনামার ওপর মূল গুরুত্ব আরোপ করেন।
তবে এই বইয়ের সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ অংশ পরিশিষ্ট ১ ও ২-এ সংযোজিত সাক্ষাত্কার ও চিঠিপত্র। যেমন, শওকত আলী খোয়াবনামার 'কুলসুম' চরিত্র সম্পর্কে বলছেন, 'আমার মনে হয়, চরিত্রটি অত্যন্ত Practical…আমার জানাশোনার মধ্যেই আছে। এই ঢাকা শহরেই আছে, বিবাহিত জীবনযাপন করছে কিন্তু প্রেমিককে ভোলেনি। দেহদান হয়তো করেনি, সে সুযোগ পাচ্ছে না, কিন্তু প্রেমিকের স্মৃতিকে মনে গেঁথে রেখেছে। এই বিষয়গুলো একেবারে কাজের মেয়ে যারা আছে তাদের মধ্যেও আমি দেখেছি।'
ইলিয়াসের স্ত্রী সুরাইয়া ইলিয়াস যে বলেছেন, 'শিল্পী বা সাহিত্যসেবী হিসেবে আমার স্বামী কেমন ছিলেন তা যেমন জানেন তাঁর সাহিত্যের পাঠক-সমালোচকেরা তেমনি ব্যক্তি হিসেবে কেমন ছিলেন তা আমার চাইতেও বেশি জানেন তাঁর বন্ধুবান্ধবের দল' তাতে ইলিয়াসের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য শনাক্ত হয়—ব্যক্তি ও লেখক, উভয়েরই। আবার ইলিয়াসের সাহিত্য বোঝার জন্য শুধু তাঁর লেখাই নয়, তাকেও পড়া দরকার। এই গবেষণাকর্মে গৃহীত সাক্ষাত্কারগুলোর মধ্য দিয়ে আলাউদ্দিন মণ্ডল সে কাজ অনেকটাই এগিয়ে রেখেছেন।
সুরাইয়া যেমন বলেছেন, ইলিয়াসের প্রবণতা ছিল তৃণমূলের মানুষের বিষয়ে আন্তরিক আগ্রহ, তাঁদের গ্রামের বাড়ি কোথায়, পরিবারে কজন সদস্য, সংসার কীভাবে চলে ইত্যাদি। আবার মির্জা হারুন-অর রশিদ যেমন চিঠিতে জানিয়েছেন, প্রাথমিক অধিদপ্তরের ডেপুটি ডাইরেক্টর থাকার সময় গ্রামে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বাস্তব অবস্থা ও বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত বিষয় নিয়ে যেমন সরেজমিন অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন বরেন্দ্রভূমিতে গিয়ে তেমনি সেখানকার সৌন্দর্য, নৃতত্ত্ব ও স্থাপত্য বিষয়ে অনুসন্ধান করেছেন। পরিশ্রুত হলেও মূল এই ভিত্তিই তাকে খোয়াবনামা রচনায় অনুপ্রাণিত করে।
তবে এই বই পড়তে গিয়ে কোথাও কোথাও হোঁচটও খেয়েছি। যেমন ৭১ পৃষ্ঠায় আইয়ুব খানের তথাকথিত সাফল্যে লেখকের সমর্থন। ৯১ পৃষ্ঠায় ইলিয়াসের দিনপঞ্জিতে যে বলা হয়েছে 'সাম্রাজ্যবাদী (সাম্রাজ্যবাদের?) দোসর আইয়ুব খান। ঋণের মাধ্যমে পাকিস্তানকে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন শক্তির কাছে জিম্মি রাখা হয়েছে'র পরও বোঝাই যাচ্ছে, তিনি আসলে কী ছিলেন। ২১ পৃষ্ঠায় ইলিয়াসকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে দৈনিক সংবাদ কেন ধারাবাহিক উপন্যাস চিলেকোঠায় ছাপা বন্ধ করে দিয়েছিল। অথচ ৫৯১ পৃষ্ঠায় দিলীপ পাল তাঁর সাক্ষাত্কারে একই উপন্যাস সম্পর্কে বলেছেন, 'আমার সমালোচনার পর ইলিয়াস লেখাটা বন্ধ করে দিয়েছিল।' প্রসঙ্গত, উপন্যাসটি তার পরও সাপ্তাহিক রোববার-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
মুদ্রণপ্রমাদ বইটির মানকে ক্ষুণ্ন করেছে। ২৭ পৃষ্ঠায় 'মানিক' হয়েছে 'মাণিক', ১৪৩ পৃষ্ঠায় 'ইমেল্ডা' 'ইমেণ্ডা' মির্জা হারুন-অর রশিদ-এ 'ণ' ও 'ন' উভয়ই ব্যবহূত হয়েছে। তাঁর লেখা চিঠিতে জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের নাম 'সাইফুর' ছাপা হয়েছে। লেখা হয়েছে '…মির্জা হারুন-অর রশিদ সাহেবের দুটি চিঠি'। আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে 'সাহেব' কেন? স্মর্তব্য, অগ্রজ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের উক্তি, "জীবনী লিখিবার অনুরোধে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকেও কেবল সঞ্জীবচন্দ্র লিখিতে বাধ্য হইতেছি।…বিশেষ তিনি আমারই 'দাদা মহাশয়', কিন্তু পাঠকের কাছে সঞ্জীবচন্দ্র মাত্র। অতএব দাদা মহাশয় দাদা মহাশয় পুনঃপুনঃ পাঠকের রুচিকর না হইতে পারে।"
বইতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সরাসরি সংক্ষিপ্ত জীবন ও গ্রন্থপঞ্জির অভাব অনুভব করেছি। অভাব বোধ করেছি নির্ঘণ্টেরও।
সব মিলিয়ে ইলিয়াস-পাঠে লেখক যে উদ্যোগ ও ভালোবাসার পরিচয় দিয়েছেন সে জন্য তাঁকে অভিনন্দন।

জনসংস্কৃতি মঞ্চে কিছু পান্ডবের আস্ফালন ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ১০:০০

শেয়ার করুনঃ
000

আমি চারুকলা থেকে বের হয়ে ১১ তারিখ একটু অন্যমনস্কভাবে ফুটপাথের বইগুলা দেখতে দেখতে নাটমন্ডলের দিকে যাচ্ছিলাম,হঠাতই এক মুশকো জওয়ানের ধাক্কা খেয়ে তাল সাম্লাতে গিয়ে দেয়ালে চোখ পড়লো,দেখি ১২ তারিখ(মানে গতকাল)জনসংস্কৃতি মঞ্চে বক্তব্য রাখবেন আনু মুহম্মদ,সলিমুল্লা খান এবং ফারুক ওয়াসিফ।প্রসংগ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচনাবলী।
দেখে ঠিক করলাম এখানে যাওয়া উচিত।যেই ভাবা সেই কাজ।

পরদিন ঢাঃবিঃর লেকচার থিয়েটারের আর,সি মজুমদার অডিটোরিয়ামে বিকেল চারটায় গেলাম।শুরু হলো আরো কিছু পরে।

প্রথমে আলচনা কোরলেন ঢাঃবিঃ বাংলার শিক্ষক মোহাম্মদ আযম।তার আলোচনায় বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইলিয়াসের বিশ্লেষন পেলাম।তিনি ইলিয়াসের ছোটগল্প,উপন্যাস দু'খনা,এবং প্রবন্ধের ভুয়সী প্রসংসা করলেন।

এরপর ফারুক ওয়াসিফ আলচনায় আস্লেন।তার দীর্ঘ আলোচনায় তিনি পোর্ট উইলিয়ামস কলেজের নিন্দা করেন।কেননা উপনিবেশিক আমলে তারা ভাষাকে কেটে ছেটে ভদ্র করার রীতি চালু করে,এবং এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল বাংলার ততকালীন সমাজ।

ফারুক ওয়াসিফ মনে করেন বাংলার এই সুশীল ভাষাচ্ররচার একপর্যায়ে বাংলা উপন্যাসের সৃস্টি।বংকিমের রচনায় সে সময়ের উপনিবেশিক প্রভাব নিয়েও কিছু কথা বলেন।তার ভাষার ততকালীন সুশিলতা যাকে লেজুরবৃত্তি বলেন তিনি।

ওয়াসিফ বিস্ময় প্রকাশ করেন যে এসব নেতিবাচক প্রভাবের মাত্র ৫০-৬০ বছর পর ইলিয়াসের রচনার ভাষা অনেক কার্যকরী ও প্রান্তিকদের কথা বলে,সে বিষয়ে।তিনি মনে করেন চিলেকোঠার সেপাই'ইয়ের হাড্ডি খিজির একজন প্রান্তিকদের প্রতিনিধি।
তার দীর্ঘ আলোচনা এখানে সংক্ষেপ করলাম।

এরপর আসেন পিয়াস করিম যিনি সম্প্রতি বিদেশ থেকে এসেছেন এবং জনসংস্কৃতি মঞ্চের সক্রিয় সদস্য বলে ঘোষক পরিচয় দেন।

পিয়াস করিম মনে করেন ইলিয়াসের রচনায় একটি পোস্ট রিয়ালিস্টিক বিষয় আছে।কেননা ইলিয়াস তার সব রচনাতেই এক্তা অমিমাংসিত ভাব রেখে দেন।

পিয়াস করিম মনে করেন যে ইলিয়াসের প্রান্তিক চরিত্ররা যখন আন্দোলনে পাগল হয়ে যা-তখন মনে হয় যেন তারা যে জেনেশুনে করছে তা নয়,বরং একটা সিজফ্রেনিক রোগীর মতো ঘোর নিয়ে এ সব করে।ঊদাহ্ররণ হিসেবে তিনি খোয়াবনামার তমিজের বাপ ও চিলেকোঠার সেপাই'ইয়ের রঞ্জু ও হাড্ডি খিজিরের কথা বলেন।

এরপর তিনি একটি ব্যাক্তিগত অভিমত দেন যে তার নাকি ইলিয়াসে গল্প,ঊপন্যাস ভাল লাগে কিন্তু ইলিয়াসের প্রবন্ধ ভাল লাগেনা।কারণ সে গুলোতে যেন একটু বেশী বেশীই মার্ক্সিস্ট গন্ধ তিনি পান যা তার মনে হয় এত বেশী না বললেও হতো।

এরপর ঘোষক সলিমুল্লা খান-কে আসতে বলেন,যাকে তিনি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও চিন্তাবিদ বলে পরিচয় দেন।

প্রথমেই সলিমুল্লা খান বিরক্তি প্রকাশ করেন যে ফারুক ওয়াসিফ তার বক্তব্য অনেক দীর্ঘ করে ফেলেছেন তার উচিত ছিলো অন্যদেরো কথা বলার সুযোগ দেয়া।তিনি একারণে খুব বেশী কিছু বলবেন না বললেন।ফলে যথারিতি গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো হলে।

এরপর তিনি সবাইকে আশবস্ত করার মত একটা ভংগি করে তার আলোচনা আরম্ভ করলেন।

প্রথমেই তিনি বললেন যে পিয়াস করিমের সাথে একমত নন এবং তার আসলে ইলিয়াসের প্রবন্ধই ভাল লাগে,বরং উপন্যাস ভাল লাগেনা ও তিনি সেটা পড়তে পারেন না।এর কারণ হিসেবে সলিমুল্লা খান মনে করেন চিলেকোঠার সেপাই বা খোয়াবনামায় ইলিয়াস ভাষার নিরিক্ষন চালিয়েছেন যার কারণে তার মতো এই মুর্খ ব্যক্তি সে ভাষা বুঝতে পারেন না।একারণে ইলিয়াসের উপন্যাস তার ভাল লাগেনি এবং তিনি তা পড়েননাই।
এরপর সলিমুল্লা খান বলেন যে যখন চিলেকোঠার সেপাই সে সময়ের দৈনিকে ধারাবাহিক ভাবে ছাপা হচ্ছিল তখন কিছু সংখ্যা পড়ার পর তার আর কোনো আগ্রহ জাগেনি।

সলিমুল্লা খান এবার ইলিয়াসের সংস্কৃতির ভাংগা সেতু থেকে কিছু উদ্ধৃতি পড়ে শোনান জনসংস্কৃতি শব্দটির অরথ নির্ণয়ের জন্য।সেখানে দেখআন যে ইলিয়াস তিন প্রকার সংস্ক্বরতির কথা বলেছেন।

তিনি বলেন ইলিয়াসের কথা অনুযায়ী এই মঞ্চ জনসংস্কৃতি বলতে প্রান্তিক বা শ্রমিকদের সংস্কৃতির কথা বোঝাচ্ছে।তিনি ইলিয়াসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে মধ্যবিত্ত অপসংস্কৃতি দারা আক্রান্ত।
ইলিয়াসে আরেক উদ্ধৃতির কথা তিনি বলেছেন যেখানে ইলিয়াস তথাকথিত বাম সংগথনের সমালচনা করেছেন এবং বাম কর্মীরা কখনো শ্রমিকদের সাথে একাত্ন হতে পারে না ,কারণ তারা শ্রমিকদের সাথে মিশবার জন্য যে গভীর মর্যাদাবোধ দরকার তাদের তা নেই।একারণে বাম আন্দোলনগুলো বা সংগঠনগুল লিটল থিয়েটার হিসেবে রয়ে যায়,কখনো কাজে আসে না।
এ প্রসংগে তিনি বলেন এরুপ মঞ্চগুলো থেকে মধ্যবিত্তের অপসংস্কৃতিকে অনেক গালিগালাজ করা হয়।বর্তমানে এ গালিগালাজের হার মোটামুটি কমেছে বলে আনু মুহম্মদকে উদ্দেশ্য করে সন্তুস্টি প্রকাশ করেন। 

তিনি বলেন অনেকক্ষেত্রে ইলিয়াস সংস্কৃতি বলতে ইন্সট্রুমেন্টাল এলিমেন্টস যেমন নাটক,গান,কবিতা ইত্যাদি ব্যভার করেছেন বলে তার মনে হয়েছে।
তার এ মতের বিরোধিতা করেছেন ফারুক ওয়াসিফ মাথা নেড়ে।
এর কিছুক্ষণ পর তিনি তার আলোচনা শেষ করেন।

এরপর বক্তা হলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাই ওয়াহেদুজ্জামান ইলিয়াস।তিনি কিছুক্ষেত্রে সলিমুল্লা খানের সাথে এক্মত নন বলে অল্পকথায় শেষ করেন।

সবশেষে আনু মুহম্মদ বলেন কারো আলোচনাই আসলে তেমন দীর্ঘ হয়নি।তিনি মনে করেন সমালচনা হতেই পারে তবে সেটা পাঠ করে সমালচনা করলে ভাল হয়-বলা বাহুল্য এই কথা আসলে সলিমুল্লা খান-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন।

আনু মুহম্মদ স্মৃতিচারন করে বলেন ইলিয়াসের সাথে একসাথে কাজ করার কথা।ইলিয়াস কে তিনি জাতিয় লেখক শিবিরে যোগ দেবার জন্য যখন আহবান করতে যান ইলিয়াস জিজ্ঞাসা করেন যে সাথে ফরম আছে কি-না।তিনি সাথে সাথেই যোগ দেন।আনু মুহম্মদ বলেন ইলিয়াস আসলে একটি সাংগথনিক ব্যানারে যোগ দেবার জন্য মুখিয়ে ছিলেন,কেননা তিনি সশরীরে কাজ করতে চাচ্ছিলেন।
এর কিছুক্ষন পর তিনি তার আলচনা শেষ করে অনুস্ঠান শেষ করেন।

আমি এ কথা ভাবতে ভাবতে ফেরত এলাম যে আমাদের আলোচনাগুলোর নিস্পত্তি ও চুড়ান্ত সমাধান কবে হবে?

 

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ 

http://www.somewhereinblog.net/blog/muizblog/28770155

আর্থিক সঙ্কটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস গুপাঠাগার
স্বপ্ন ভঙ্গের শঙ্কায় তরুণ উদ্যোক্তারা
মোরসালিন মিজান ॥ অমর একুশের মাসে যখন হাজারও মানুষের ঢল নামছে বাংলা একাডেমীতে, পছন্দের বই সংগ্রহের কাজে যখন ব্যস্ত পাঠক; ঠিক তখন অসত্মিত্ব রৰার কঠিন সংগ্রাম করছে আখতারম্নজ্জামান ইলিয়াস গণপাঠাগার। বাংলা সাহিত্যের ৰণজন্মা এ লেখকের নামে মিরপুরের পল্লীবীতে বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে তোলা পাঠাগারটি আর্থিক সঙ্কটের কারণে বন্ধ হতে চলেছে।
জানা যায়, প্রয়াত লেখকের অনুরাগী একদল স্বপ্নবাজ তরম্নণ ২০০৭ সালে পাঠাগারটি গড়ে তোলেন। জেএমজে ফেরদৌস, রণজিৎ মজুমদার, মাহবুব ইরান, কাজী মুনতাসীর বিলস্নাহ মিশুসহ ২৫ জন ছিলেন মূল উদ্যোক্তা। আরও ২৫ জনের মতো শিৰাথর্ী ও পেশাজীবী তখন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। পাঠাগারের উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে গঠন করা হয় ২১ সদস্যের একটি পরিচালনা কমিটি। এ কমিটির অন্যতম সদস্য জেএমজে ফেরদৌস জানান, পাঠাগারের উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন বিশিষ্ট চিনত্মাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও আনু মুহম্মদসহ আরও বিশিষ্ট ব্যক্তি। জানা যায়, শুরম্নতে উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই ছিলেন বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিৰাথর্ী। বড়দের এককালীন চাঁদা ও নিজেদের ব্যক্তিগত খরচের টাকা থেকে বাঁচিয়ে পাঠাগার পরিচালনার কাজ শুরম্ন করেন তাঁরা। এ জন্য মাসিক তিন হাজার টাকায় একটি বাসা ভাড়া নেয়া হয়। ক্রয় করা হয় প্রয়োজনীয় আসবাব। ফেরদৌসের ভাষায়, এক বড় ভাই প্রদান করেন কম্পিউটার। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে বই কেনার চেয়ে বেশি নজর দেয়া হয় সংগ্রহের দিকে। প্রথমেই নিজেদের সব বই পাঠাগারে দান করেন উদ্যোক্তরা। শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় বেশ কিছু বই। এর বাইরে অল্প টাকায় পুরনো বই কেনা হয় নীলৰেত থেকে। এভাবেই কাজ শুরম্ন হয় পাঠাগারের। ফেরদৌস কিছুটা গবের্র সঙ্গেই জানান, বর্তমানে পাঠাগারের বই সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি। প্রতিদিন বিভিন্ন বয়সী পাঠক এখানে বই পড়তে আসেন। দুই জনের সৌজন্যে রাখা হয় দু'টি দৈনিক পত্রিকাও। শুধু তাই নয়, পাঠাগারকে ঘিরে সারা বছর চলে সৃষ্টিশীল নানা কর্মকা-। সবাই যখন ভুলে থাকেন তখন পরম শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতায় আখতারম্নজ্জামান ইলিয়াসের জন্ম ও মৃতু্য দিবস পালন করে পাঠাগার। একইভাবে উৎযাপন করা হয় অন্য অনেক জাতীয় ব্যক্তিত্বের জন্ম ও মৃতু্যবার্ষিকী। জাতীয় দিবসগুলোতে আশপাশের স্কুল, কলেজের ছেলেমেয়েদের কলকাকলীতে সরব হয়ে ওঠে ভবনটি। পাঠাগার সূত্র জানায়, এখানে নিয়মিত আয়োজন করা হয় পাঠচক্র। প্রতিমাসে একবার করে বসে সাহিত্য, কবিতা ও বিজ্ঞানের আসর। নিয়মিত প্রদর্শিত হয় চলচ্চিত্রও। শিশু-কিশোরদের সৃষ্টিশীল কর্মকা-কে উৎসাহিত করতে 'গঙ্গাফড়িং' নামের একটি সাহিত্য সাময়িকীও প্রকাশ করা হয় পাঠাগারের পৰ থেকে। আর তাই খরচও বাড়তে থাকে। কিন্তু সে অনুযায়ী অর্থের সংস্থান করা কঠিন হয়ে পড়ে। বরং ব্যক্তিগত ব্যসত্মতা বাড়ায় প্রাথমিক উদ্যোক্তাদের অনেকেই এর সঙ্গে আগের মতো যোগাযোগও রৰা করতে পারেন না। পাঠাগারের আরেক পরিচালক মুনতাসীর বিলস্নাহ মিশু জানান, নিজেদের ও শুভানুধ্যায়ীদের সামথর্্য অনুযায়ী দেয়া চাঁদায় কোনভাবে চলছিল কার্যক্রম। কিন্তু দিন যত যাচ্ছিল ততোই প্রকট হচ্ছিল অর্থ সঙ্কট। তিনি জানান, এরই ধারাবাহিকতায় গত তিন মাস বাড়ি ভাড়ার সামান্য টাকাও পরিশোধ করতে পারেননি তারা। লাইব্রেরিয়ানের বেতন বকেয়া পড়েছে। আর তাই সম্প্রতি বাড়িটি ছাড়ার জন্য নোটিস দিয়েছেন বাড়ির মালিক। শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার পস্ন্যাটফর্ম হয়ে ওঠা বাড়িটিতে তিনি মার্কেট গড়ে তুলতে চান। বাড়ি ভাড়া নিশ্চিত করতেই গ্রহণ করতে চান এমন উদ্যোগ। কিন্তু এত ভালবাসার পাঠাগারটি বন্ধ হয়ে যাবে, এখানে বাজার বসবে_ এমনটি মানতে পারছেন না বিরম্নদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে লড়ে যাওয়া তরম্নণরা। দিনরাত ভাবছেন, আখতারম্নজ্জামান ইলিয়াসের নামে গড়া প্রিয় পাঠাগারটি কী করে রৰা করবেন।
কিন্তু কোন রাজনৈতিক দল বা নেতিবাচক ইমেজের ব্যক্তির কাছ থেকে কোন ধরনের সহায়তা তারা নিতে নারাজ।
কোন সরকারী সহায়তা চাওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে উদ্যোক্তারা বলেন, পাঠাগারকে কোন অর্থসহায়তা করা হয় না। এ জন্য এনজিওর মতো করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রেশন নিতে হয়। আমরা সেটি চাই না। তাহলে কীভাবে টিকে থাকবে পাঠাগার জানতে চাইলে তরম্নণদের চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। বলেন, বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে যারা ভালবাসেন, যারা আখতারম্নজ্জামান ইলিয়াসের পাঠক, আমরা তাদের সহায়তা চাই। তারা এগিয়ে আসলেই ঘুরে দাঁড়াবে পাঠাগারটি। এ আশাতেই দিন গুনছে সমাজ বদলের স্বপ্নে বিভোর এক দল তরুণ।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=42&dd=2010-02-27&ni=9755

ছঁেড়া খোয়াবের খাতা ঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা

Posted by bangalnama on June 1, 2010

 
 
1 Votes

লিখেছেন – সোহিনী


জোতদার মহাজনে মনে মনে উহাদের পিরীত ।
চাষার মুখের গেরাস খাওয়া দুইজনেরই রীত ।।
চাষার বড় দুশমন এই দুইজন যেমন পাখির দুশমন খাঁচা ।
চোরের দুশমন চান্দের পহর পোকের দুশমন প্যাঁচা ।। ..
বলি জমিদারি উচ্ছেদ করি এমন আইন চাই ।
জোতদার পাবে এক ভাগ ফসল চাষায় দুই ভাগ পাই ।।
(কেরামত আলির গান, খোয়াবনামা)


চল্লিশের দশক। দুর্ভিক্ষ, আধিয়ার বিদ্রোহ পেরিয়ে জোট বাঁধছে বাংলার কৃষক। যুদ্ধের বাজারে কাজ এবং মজুরি কমছে, বীজ কেনার টাকা নেই, গঁায়ের মানুষের আধপেটা খেয়ে দিন গুজরান, তারই মধ্যে স্লোগান উঠছে 'নিজ খেলানে ধান তোলো', 'জোতদার মজুতদার হুঁশিয়ার'। এদিকে পাকিস্তান প্রস্তাব, ছেচল্লিশের ভোট, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ইতিহাসের পট বদলাচ্ছে জোর লয়ে। দেশ ভাগ হচ্ছে। এসবেরই মাঝে কোন এক গঁায়ে, কোন এক সময়ে, 'তমিজের বাপ' বলে পরিচিত মূর্তিমান প্রেতাত্মা কিনা একহাঁটু কাদাজল ঠেলে বিলের ধারে পাকুড় গাছের ডালে দেড়শো বছর আগের গোরা-ঠ্যাঙানো ভবানী সন্ন্যাসীর পাঠান সেনাপতি 'মুনসি'কে একঝলক দেখার আশায় দিনের পর দিন আসমানের মেঘ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে! তমিজের বাপ বড় বিচিত্র জীব। তার জন্ম-মৃত্যুর বিবরণ, এমনকি নামও জানা যায়না। অনন্ত ঘুম আর আধো-জাগার অবসরে মুখে মুখে শোলোক আউড়ে গাঁয়ের লোকের ব্যাখ্যাতীত স্বপ্নের বাখান করে বেড়ানো একটা অলৌকিক মানুষ। বাস্তবতা বলতে আছে তার ফকিরি, আকালের বছরগুলোর ভিক্ষাবৃত্তি, বিন-মজুরিতে বেগার খাটার বদভ্যাস, আর হাড্ডিসার শরীরের অপরিসীম, অপরিসীম খিদে। এহেন তমিজের বাপের হেফাজতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'খোয়াবনামা' – চেরাগ আলি ফকিরের আঁকিবুকি কাটা খাতা- যাতে পাওয়া যায় সমস্ত রকমের স্বপ্নের হদিশ। একভাবে দেখলে তমিজের বাপ নিজেই খানিকটা এই উপন্যাসের অবয়ব। ঘটমান বর্তমানের সঙ্গে যার নিবিড় যোগ থেকেও সেখানেই যে সীমাবদ্ধ নয়, যাবতীয় ভূত এমনকি অনাগত ভবিষ্যতের মধ্যে যে অতীন্দ্রিয় একটা যোগসূত্র। তেভাগা-দেশভাগের নেপথ্যের উপকথা লিখতে বসে স্মৃতির সঙ্গে বাস্তব, ইতিহাসের সাথে কিংবদন্তী, প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামের পাশাপাশি তাদের পূর্বজদের কথা পরতে পরতে মিশিয়ে দিয়ে ইলিয়াস নির্মাণ করেছেন আশ্চর্য জাদু-আখ্যান। এই কাহিনী ইতিহাস না হয়েও তাই ইতিহাসপাঠের অংশ বটেই।


"উত্তর থেকে পশ্চিম থেকে নতুন নতুন ঢেউ আসছে, বর্গাদাররা সব ধান নিজেদের ঘরে তোলার জন্য একজোট হচ্ছে।"


"পশ্চিমে ধান কাটতে গিয়ে আধিয়ারদের কান্ডকারখানা তো তমিজ দেখে এসেছে নিজের চোখেই.. জমি হ'ল জোতদারের, ফসল কে কী পাবে সেটা তো থাকবে মালিকের এক্তিয়ারে। অথচ ফসলের বেশিরভাগ দখল করতে আধিয়াররা নেমে পড়ে হাতিয়ার হাতে।…. জোতদার নাকি পুলিসের সঙ্গেও কথা বলে রেখেছিলো। তা পুলিস যাবে আর কত জায়গায়?- সেদিন ভালো মজুরির চুক্তিতে আপখোরাকি কাজে নেমেছিলো তমিজ। ধুমসে কাজ করছে, যত তাড়াতাড়ি পারে ধান কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু দুপুর হতে না হতে এতগুলো মানুষের হৈ হৈ শুনে ভাগ্যিস সময় মতো দৌড় দিয়েছিলো। চাষাদের বউ-ঝিরা পর্যন্ত ঝাঁটা খুন্তি বঁটি নাকড়ি নিয়ে তাড়া করে। ধানখেতের ভেতর দিয়ে, কাটা ধানের আঁটি ডিঙিয়ে এবং কখনো সেগুলোর ওপর পা রেখে ছুটতে না পারলে ঝাঁটা কি খুন্তির দুই একটা ঘা কি তমিজের গায়ে পড়তো না! কয়েকটা বাড়ি যে পড়েনি তাই বা কে জানে বাপু! মেয়েমানুষের হাতে মার খেয়ে কেউ কি তা চাউর করে বেড়ায়।…আধিয়ারদের এরকম বাড়াবাড়ি তমিজের একেবারেই ভালো লাগেনি। জমি হ'ল লক্ষ্মী, লক্ষ্মীর বেটাবেটি হলো তার ফসল। সেই ফসল নিয়ে টানাটানি করলে জমির গায়ে লাগে না? ফসল হলো জমির মালিকের জানের জান। তাই নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করলে বেচারা বাঁচে কী করে?"


তমিজের বাপ রহস্যময় চরিত্র হলেও তমিজ খাঁটি রক্তমাংসের মানুষ। মাঝির বেটার অনেকদিনের হাউস, সে চাষী হবে। এদিকে গরু-লাঙল-জোয়াল-মই-বীজচারা কেনার পয়সা নেই। ফলে নিজের গ্রাম থেকে দূরে খিয়ারের পাঁচশ' বিঘা জমির জোতদারদের ক্ষেতে কামলা খাটতে গিয়ে এইভাবেই তমিজের প্রথম মোলাকাত হচ্ছে বিদ্রোহী আধিয়ারদের সঙ্গে। এবং বলাই বাহুল্য সামন্তী সমাজের অভ্যস্ত নৈতিকতায় আধিয়ারদের দাপাদাপি তার কাছে অন্যায্য ঠেকছে। বাধ্য ভূমিহীন প্রজার মতই সে জমির ফসলের ওপর জমিদারের প্রশ্নাতীত অধিকারের পক্ষ নিয়ে নিচ্ছে। এবং বহু হাতে পায়ে ধরে যখন জোতদার শরাফত মন্ডলের ছেলে, লীগকর্মী, আবদুল কাদেরের সুপারিশে নিজের গাঁয়ে এক টুকরো জমি বর্গা করার সুযোগ পাচ্ছে, জোতদারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ছে তমিজ। ফসল দিতে অনিচ্ছুক বুড়া হুরমতুল্লার ওপর তার স্বাভাবিক রাগ ঝরে পড়ছে – "জমির মালিককে তার ভাগের ফসল দিতে বুড়ার বুক টনটন করে। নিমকহারাম!"


সুরুজে বিদায় মাঙে শীতে সে কাতর ।
শীষের ভিতর ধান কাঁপে থরথর ।।
পশ্চিমে হইল রাঙা কালা পানি অচিন ডাঙা
ফকিরে করিবে মেলা রাত্রি দুই পহর ।
ধানের আঁটি তোলো চাষা মাঝি ফিরো ঘর ।।
(চেরাগ আলীর গান, খোয়াবনামা)


কিছুটা সময় কেটেছে। আসুন তমিজকে আবার খানিকক্ষণ অনুসরণ করি। এক ফালি বর্গা জমি পেয়ে অবধি তমিজের মধ্যে আসছে পরিবর্তন। শরীরের সমস্ত শক্তি ঢেলে অদম্য উৎসাহে আমন চাষ করছে সে। দিন নেই রাত নেই পড়ে থাকছে ক্ষেতে। জান নিংড়ে দিয়ে মেহনতের ফসল তুলতে পাগল হয়ে উঠছে। হুরমতুল্লার ধমক খেয়ে শিখছে ধানচাষের কৌশল– "হাত দিয়া মাটি ছানা হয় না। জমি চায় নাঙলের ফলা, বুঝলু? জমি হলো শালার মাগীমানুষের অধম, শালী বড়ো লটিমাগী রে, ছিনালের একশ্যাষ। নাঙলের চোদন না খালে মাগীর সুখ হয় না। হাত দিয়া তুই উগলান কি করিস'? বলতে বলতে হুরমতুল্লা গম্ভীর হয়ে যায় এবং কাশির দমক অগ্রাহ্য করে সে জানায়, হাত দিয়ে ছানলে রোদ একটু চড়া হলেই মাটি শক্ত হয়ে যায়। ভেতরে শক্ত হলে সেই মাটিতে ধানের চারা আরাম পায় না।" মাটির ছোঁয়ায় তমিজের শরীর জেগে উঠছে। মাটি-কে ঘিরেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন, আরেকটু সচ্ছল চাষী হবে সে। এদিকে একটু একটু করে বড় হচ্ছে তার সাধের ধানচারারা – "দিঘি, এদিকে মাঠের পর মাঠ, ওপরে আকাশ পর্যন্ত কুয়াশা জড়ানো চঁাদের আলো। তমিজের জমিতে পাতলা কুয়াশা টাঙানো রয়েছে মশারির মতো, মশারির ভেতরে চুঁয়ে-পড়া-আলোয় তার ধানগাছগুলো ঘুমিয়ে রয়েছে মাথা ঝুঁকে। চাঁদের আলো এই ধানক্ষেতে ঢুকে আর বেরোয় না, ধানের শীষে গাল ঘষতে ঘষতে ধানের রঙ চোষে চুকচুক করে। আবার আলো পোয়াতে পোয়াতে ঘুমায় সারি সারি ধানগাছ।"


তমিজকে নজর করতে করতে আখ্যানও এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। কিছু কাল পরে দেখছি ভর দুপুরবেলায় বর্গাজমিতে কাজ করতে করতে আচ্ছন্ন হয়ে খোয়াব দেখছে তমিজ। খিয়ারের ক্ষেতে সাঁওতালি আধিয়ার আর জোতদার-পুলিশের সেই যে ফসলের লড়াই দিয়ে তার প্রথম তেভাগা-দর্শন, সেই লড়াই-এর স্মৃতি নতুন নতুন অভূতপুর্ব আকারে দিবাস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসছে।


'আধিয়ারদের তাড়া খেয়ে কাটা ধান ফেলে সে দৌড় দিলো। দৌড় দৌড় দৌড়। তার গায়ে তীর বঁিধছিলো একটার পর একটা। … সঁাওতাল চাষারা জোতদারদের মারে তীর দিয়ে। তা তীরের খোঁচায় টিকতে না পেরে ….. উপায় না দেখে তমিজ তখন কাঁটাওয়ালা বাবলাডাল ভেঙে ভেঙে ছুঁড়ে মারতে লাগলো ঐ চাষাদের দিকে। কিন্তু কোন শালা কি মন্ত্র পড়ে দিয়েছে, বাবলাডাল একটার পর একটা গিয়ে লাগে জোতদারের গায়ে। শরাফত মন্ডলের গলার ঠিক নিচে বাবলাকাঁটা লেগে রক্ত বেরুচ্ছে। বাপের পেছনে দাঁড়িয়ে আবদুল আজিজ আবদুল কাদের দুই ভাই। অন্ততঃ আবদুল আজিজের মুখ বরাবর কাঁটাওয়ালা মোটা একটা বাবলাডাল লাগাবার জন্য তমিজ নানাভাবে চেষ্টা করে, কিন্তু জুত করতে পারেনা। তমিজ আরো ডাল ভাঙতে লাগলো। জোতদার শালা ঝাড়েবংশে হারামজাদা। শালার একোটা মাক্কুচোষা। তমিজের এত কষ্ট, এত মেহনত, এত কষ্টের মেহনতের ফসল সব নিয়ে তুলতে হবে শালাদের মোটা মোটা গোলায়।"


কিন্তু এ কোন তমিজ! তিন মাস আগের সেই কামলা-খাটা নিরীহ মাঝির বেটা এখন দু'বিঘের বর্গাজমির ভূমিপুত্র হয়ে কিনা খোয়াবের মধ্যে জোতদার প্যাঁদাচ্ছে! তমিজের মনে তবু পাপবোধের দোলাচল জাগে। একবার শরাফতের প্রতি প্রজাসুলভ কৃতজ্ঞতা আর একবার নিজের পরিবর্তিত অবচেতনের ছায়া দেখে নিজের বেইমানিতে হয়তো খানিকটা অনুশোচনা বোধ করে।


মাদারি নামিল জঙ্গে হস্তে তলোয়ার।
কোম্পানি সিপাহি মরে কাতারে কাতার ।।
গোরা টেলর হস্তে ধরে কামান বন্দুক ।
মাদারিরে দেখি তার সিনা ধুকধুক ।।
মজনু হাঁকিয়া কয় ভবানী সন্ন্যাসী ।
গোরাগণে দরো আর দাও সবে ফাঁসি ।।
গিরিবৃন্দ অসি ধরে ভবানী হুংকারে ।
গোরাগণে পাঠাইয়া দেয় যমদ্বারে ।।
(মুনসির শোলোক, খোয়াবনামা)


কিন্তু ইলিয়াস তো তেভাগা-দেশভাগকে পারম্পর্যহীন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দ্যাখেননা। তাই খোয়াবনামায় দেড়শো বছরের পুরোনো ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে – শোলোকে, গানে ছড়ায়, মজনু শাহের মেলা আর কাৎলাহার বিলের লোকজ ইতিহাসে। মানুষের বিদ্রোহ আর লড়াইয়ের উত্তরাধিকার, নৈতিকতা আর লোকজ বিশ্বাস এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে চলকে পড়ে, থেকে যায় অবচেতনের পরতে। খোয়াবের ভেতর। হিসেব মেলাতে না পারলে তমিজের বাপেরা তার মানে বাতলে দেয় ঠিকঠাক।


তমিজের মত শরাফতের চরিত্রটিও জীবন থেকে উঠে আসা। তার বাপচাচাকে হিন্দু জমিদারের নায়েব তুইতোকারি করলেও এখন জমির মালিক হওয়ার সুবাদে সে ন্যূনতম সম্মান অর্থাৎ 'তুমি' সম্বোধন পায়। শরাফত এবং তার ছোট ছেলে, মুসলিম লীগের উৎসাহী কর্মী, আবদুল কাদেরের মধ্যে দিয়ে একদিকে লীগের নেতা ও পৃষ্ঠপোষকদের শ্রেণীচরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আরেক দিকে সতীশ মোক্তার-ইসমাইল হোসেন-রা 'কায়েদে আজম জিন্দাবাদ', 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' বা শ্যামাপ্রসাদের জিগির তুলে কীভাবে সুকৌশলে তেভাগার দাবিগুলোকে অধিকার করে নিচ্ছে – এই ব্যাপারগুলো জ্যান্ত হয়ে উঠেছে।


আবদুল কাদের বলছে, "পাকিস্তানে জমিদারি সিস্টেম উচ্ছেদ করা হবে। বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ করা হবে। পাকিস্তানে নিয়ম হবে জমি তার লাঙল যার। পাকিস্তানে আমিরে গরীবে ফারাক থাকবে না। ইসলাম তো সব মানুষকে সমান অধিকার দিয়েছে। ইসলামে কোনো কাস্ট সিস্টেম নাই। আমাদের নবী এই কথা বলে গেছেন কত আগে। কম্যুনিস্টরাই এসব ধার করেছে ইসলামের কাছ থেকে। " অর্থাৎ ইসলামি রাষ্ট্রই সব শ্রেণীসমস্যার সমাধান।


প্রত্যুত্তরে ছোটমিয়া বলে -


"তোমাদের লীগের বড় বড় হোমরাচোমরা তো সবই জমিদার আর বড়োলোক। তাদের উচ্ছেদ করলে তোমাদের পার্টি টঁিকবে কী করে?"


কাদেরের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর থাকে না।


অথচ এ শুধুই কল্পিত কাহিনী নয়। ১৯৪৫-এর মুসলিম লীগের ইস্তেহারে এমনকি তেভাগার থেকে একধাপ এগিয়ে গিয়ে পাকিস্তান নামক বেহেস্তে কৃষককে সম্পূর্ণ ফসল অর্থাৎ চৌভাগার অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়। তাজ-উল ইসলাম হাশমী লিখছেন– 'Ghiasuddin Pathan, a prominent Muslim League leader of the district (Mymensingh) is said to have told the Muslim sharecroppers who were with the Communists that they should not waste time and energy for Tebhaga since Pakistan was in the office and they would get all lands or Choubhaga after the mass expropriation of all Hindu landlords."


এবং এর পর আসে দ্বিখন্ডিত স্বাধীনতা। বছর গড়িয়ে যায়। স্বার্থসিদ্ধি, ক্ষমতার বাঁটোয়ারা হয়ে গেলে পরে তমিজদের হাতে রাখার প্রয়োজন ফুরায়। অাখ্যানেও দেখতে পাচ্ছি শরাফত হোসেনের মেহেরবানির মেয়াদ শেষ। তমিজের বাপের বিল-দখল নেওয়ার জঙ্গি প্রচেষ্টার শাস্তি হিসেবে তমিজের বর্গা করার সাধ ঘুচে গেছে। আবার সে কামলা খাটবে এখন। এতদিনের পরিশ্রম, স্বপ্নের দাম মাটিতেই মিলিয়ে গ্যাছে তার। উপরন্তু নাম উঠেছে পুলিশের খাতায়। এমন পরিস্থিতিতে–


তমিজটা একেবারে নাছোড়বান্দা। "আপনেরা না কছিলেন জমির উপরে বর্গাদারের হর কায়েম করার আইন জারি হবি? ফুলজানের বাপেক আপনের বাপজান জমি থ্যাকা উঠায় ক্যাংকা কর্যা?"


আবদুল কাদের হো হো করে হেসে বলছে- "তোর বাপু এত কথাও মনে থাকে? … দুই বছর আগে অ্যাসেম্বলিতে জমিদারি উচ্ছেদের বিল উঠলে বর্গাদারদের সম্বন্ধে ঐ ধরনের একটা কথা ছিলো। ঐ বিল তো আবার উঠিছে, এই তো কয়দিন আগেই উঠলো। এবার বর্গাদারদের কথা বাদ দিছে।"


- "বাদ দিছে" ? তমিজের হাত থেকে মিহি করে সার মেশানো মাটি পড়ে যায় ঘাসের ওপর। এক আইন আবার দুইবার দুইরকম হয় কী করে? হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না – ভদ্দরলোকদের এই বচন কি ভদ্দরলোকরাই খারিজ করে দিচ্ছে !


এহেন বিশ্বাসভঙ্গে তমিজে চুপসে যায়। তবু আশার তলানিটুকু নিংড়ে জানতে চাইছে- "তেভাগা হলেও কাম হয়। তেভাগা তো হচ্ছেই, না? ….. জয়পুরেত তো যখন ধান কাটিচ্ছিলাম তখনি তো ওটি জোতদাররা সব দৌড়াচ্ছিলো পাছার কাপড় তুল্যা।"


- "এ কথা সে কথা, দে বুড়ি আলাপাতা"। কাদের তমিজের একটি ব্যাপারেই লেগে থাকা নিয়ে হাসে। "তোর খালি এক কথা। উগলান তো সব শ্যাষ হয়ে গেছে বাপু। নাচোলের দিকে এখনো মাথা গরম কিছু চ্যাংড়া–।"


তমিজের সরল বিশ্বাস দেখে আবদুল কাদের দাঁত বের করে হাসে। তার ভেতর যে স্বপ্নের বীজ বুনেছিল তেভাগা, সেই সব সাধ ব্যর্থ হয়ে গ্যাছে, এটা জেনে কী অবিশ্বাস্য ট্রাজেডি আছড়ে পড়ছে তমিজের বুকে, আবদুল কাদের তার লেশমাত্র টের পায়না। এবং এই চরম বেইমানির আঘাতের ফলেই যখন আমরা শেষবারের মতো তমিজকে দেখছি, একটা স্থির সংকল্প দেখতে পাচ্ছি তার আচরণে। সে যাচ্ছিলো ঢাকা শহর, পুলিশি মামলা থেকে বাঁচতে, কয়েকদিনের নিরাপদ আশ্রয়ে গা-ঢাকা দিতে। ঢাকার ট্রেনে উঠে পড়েছে। এমন সময়ে ভারি গোলমাল। পাশের লাইনে এসে দাঁড়িয়েছে শান্তাহারের ট্রেন। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ স্টেশন।


-তমিজ জিগ্যেস করে "ঐ গাড়ি কুটি যাবি ?"


-"শান্তাহার"।


-"শান্তাহার। শান্তাহারের গাড়ি! শান্তাহারের গাড়ির ইঞ্জিনের হুশহুশ ধ্বনি বলতে থাকে, 'শান্তাহার'! ঐ গাড়ির ইঞ্জিনের ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে লিখে দেয়, 'শান্তাহার'! অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও তমিজ এই লেখাটাই জীবনে প্রথম পড়তে পারে। শান্তাহার যাওয়া মানে সেখান থেকে যাও জয়পুর, যাও আক্কেলপুর, যাও হিলি। দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ, আবার অন্য লাইন ধরে নাটোর কিংবা নবাবগঞ্জ। এত পুলিশ যাচ্ছে, মানে চাষারা দুই ভাগ ফসল তুলছে নিজেদের গোলায়, জোতদারদের গোয়ার কাপড় খুলে গেছে, শালারা দৌড় দিচ্ছে, লুকাচ্ছে পুলিশের গোয়ার মধ্যে। আবার এর মধ্যেই আমনের জন্যে একদিকে চলছে জমি তৈরি, পাট কেটে সেই জমিতে একটা দুইটা তিনটা লাঙল চাষ দেওয়া হলো, এখন বীজতলায় কলাপাতা রঙের ধানের চারা বিছানো। জমি তৈরি হলে সেখান থেকে চারা এনে ধান রোপার ধুম পড়ে যাবে। আহা, কাল সারা রাত বৃষ্টি হলো, জমি হয়ে আছে মাখনের মতো, লাঙল ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতে ঢুকে যাচ্ছে দুনিয়ার অনেক ভেতরে, তমিজ সেখান থেকে পানি পর্যন্ত টেনে আনতে পারে। শান্তাহারের গাড়ির ধোঁয়ায় আসমানে এখন আবার লেখা হয় ধানজমির ছবি। কী জমি গো! ধানচারা রুইতে না রুইতে ধানের শীষ বড়ো হয়, ধানের শীষ দুধের ভারে নুয়ে পড়ে নিচের দিকে। মোটা মোটা গোছার ধান কাটতে নেমে গেছে কত কত মানুষ তার লেখাজোকা নাই। জোতদাররা এসেছে পুলিশ নিয়ে। রেলগাড়ি ভরা পুলিশ স্টেশনে স্টেশনে নেমে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। তারা সব কলেরার মতো নামে, গুটিবসন্তের মতো নামে। চাষারা তাদের তাড়া করেছে কাস্তে নিয়ে, শালারা ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাবার আর পথ পাচ্ছে না।"


সেই আমন ক্ষেতে শুয়ে বাবলাডাল ছুঁড়ে জোতদার মারার দিবাস্বপ্ন-দ্যাখা তমিজকে ফিরে পাচ্ছি আমরা। এই তার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ। এরপর সে সত্যি সত্যিই মিলিয়ে যাবে জনসমুদ্রে। স্ত্রী-কন্যা-সংসার-পুলিশের-খাতায়-নামের তোয়াক্কা না করে ‌ তমিজ চলে যাচ্ছে শান্তাহার। আর ফিরবে কি? এখন তো আর ফেরার জো নাই! ফিরে কাজ নাই!


বানেতে ভাসিল ধান না ভাঙিও মন ।
পঁেয়াজরসুনে হইবে দ্বিগুণ ফলন ।।
(চেরাগ আলীর শোলোক, খোয়াবনামা)


শেষ দৃশ্যে তমিজের গুলিবঁেধা দেহ পূর্ণিমার গোলালো চাঁদের গায়ে রক্তের ছোপ ফেলে মিশে যাচ্ছে আবহমান কালের লোককথার শরীরে। ভবানী পাঠকদের পাশে কোথাও জায়গা করে নিচ্ছে তেভাগার শহীদ। ফুলজানের আঁচল টেনে তার একরত্তি মেয়ে অভুক্ত রুখা গলায় একটানা জিগির তুলছে 'মা বাড়িত চল … ভাত খামো। ভাত রান্ধিচ্ছে, মা ভাত খামো'। জখম চাঁদের নিচে অসংখ্য জোনাকি পোড়ে, জোনাকির মিলিত আগুনে দাউ দাউ জ্বলছে ফুলজানের হঁেসেল। এ দৃশ্য কি স্বপ্নের, না বাস্তবের? এ প্রশ্নের কী দরকার পড়ে আর? এমন দৃশ্যে বাংলার কৃষকের ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যত সমস্তটা একাকার হয়ে যায়, রংপুর-নাচোল-কাকদ্বীপ-এর মানুষের ঐতিহাসিক বিদ্রোহে মিশে যায় কল্পিত অাখ্যানের আধিয়ার-কামলাদের ফসলের অধিকারের লড়াই। এর চেয়েও আরো বেশি কিছু হয়- স্থান ও কালের ব্যবধান মুছে যায়। সীমাহীন কাল সীমাহীন স্থান জুড়ে, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ভবানী পাঠক-মজনু শাহ থেকে শুরু করে চেরাগ আলি ফকির, তমিজ, তমিজের বাপ, ফুলজান, কুলসুম, হুরুমতুল্লা, কেরামত আলি, দুধের শিশু সখিনাও সামিল হয় একটাই স্রোতে, তারই সাথে সামিল হয় আগামীর যত নিরন্ন মানুষও। যাদের সবার চোখে ধানের খোয়াব, হঁেসেলে আঁচ-নেভা উনুন, পেটে ভুখ, নাকে ভাতের গন্ধ। মাটি আঁকড়ে লড়াই করে বাঁচাই যাদের একমাত্র অপরিবর্তনশীল বাস্তব। যতদূর ইতিহাসের দৃষ্টি যায়, এই বিশাল মিছিলের কোনো শুরু অথবা শেষ থাকেনা। শেষ থাকেনা তমিজের মাথা তোলপাড় করা কুলসুমের সেই সাদামাটা প্রশ্নটারও- 'ক্যা গো, মানষের জমির ধান কাটো, তোমার লিজের ধান তুলবা কুনদিন' ?


আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির-আকাশে
কারা যেন আজো ভাত রাঁধে
ভাত বাড়ে, ভাত খায়।
আর আমরা সারারাত জেগে থাকি
আশ্চর্য ভাতের গন্ধে,
প্রার্থনায়, সারারাত।
('আশ্চর্য ভাতের গন্ধ', বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়)


সূত্র ঃ
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, খোয়াবনামা। প্রকাশক – নয়া উদ্যোগ। প্রথম প্রকাশ – এপ্রিল ১৯৯৬। মূল্য – ১৫০ টাকা।
শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত, 'History's Creative Counterpart – Partition in Akhtaruzzaman Elias' Khowabnama', যশোধরা বাগচী ও শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পাদিত The Trauma and The Triumph, প্রকাশক – স্ত্রী, জানুয়ারী ২০০৬।


গত ১২ ফ্রেব্রুয়ারি ২০০৮ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্মবার্ষিকীতে জনসংস্কৃতি মঞ্চ একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। সেই সভায় আমি একটি আলোচনা করি। সেটার শ্রুতিলিখনটি প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় তুলে দিলাম।
* * *
প্রথম কথা হচ্ছে যে, উপন্যাস ব্যাপারটি আমাদের দেশে কোথা থেকে এলো। এবং যেটা মুহম্মদ আজম ব্যাখ্যা করেছেন যে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে; আধুনিকতা গণতন্ত্র উন্নয়ন ইত্যাদির মতো এই জিনিসটিও আমাদের দেশে আমদানি করা হয়েছে। সেই আমদানির আগের ইতিহাসের একটা বড় দাগ হচ্ছে ১৮০০ সাল — যখন কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর পরই যা হয়, তা বোধহয় পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার আর সম্ভব নয়। একটি কলেজ ও তার কয়েকজন মাস্টার মিলে একটি প্রাচীন ভাষার ওপর দর্জিগিরি ফলালেন। ভাষা সংস্কার করলেন। এ কাজে বাংলা তেমন কোনো ব্যকরণ বই পাননি। তাঁরা পেয়েছেন সংস্কৃত পুস্তক ও সংস্কৃত ব্যাকরণশাস্ত্র। আর মাথায় করে বয়ে এনেছিলেন ইউরোপীয় বিদ্যা। এই দুইয়ের মিলনে যে ঘটনাটি ঘটলো, সেটাকেই আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলে ধার্য করা হলো। যদিও বাংলা সাহিত্যের শুরু আরো অনেক আগে বলে সাহিত্যের ইতিহাসকাররা স্বীকার করেন। তাঁরা সাহিত্য পাচ্ছেন কিন্তু গদ্য পাচ্ছেন না। তাই চিন্তা ও সামাজিক আদানপ্রদানের ভাষা হিসেবে গদ্যকে তাঁরা সাজালেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। কিন্তু রহস্যটা এই যে ১৮৭০ থেকে ১৮৭৭ সাল নাগাদ এইরকম নবীন একটি গদ্যে রবীন্দ্রনাথের জন্ম হলো কীভাবে! কিংবা মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আবির্ভূত হলেন। তাহলে নতুন গদ্যের জন্মের মাত্র ৫০-৭০ বছরের মাথায় কিভাবে এরকম দুজন পরিণত লেখকের জন্ম সম্ভব হচ্ছে! এর একটা ব্যাখ্যা হচ্ছে, ভাষাও আবদুল কাদের জ্বিলানী হতে পারে। এই অলৌকিকে বিশ্বাস না করলে আমাদের মানতে হয় যে, এই ভাষায় সাহিত্যের দীর্ঘ চর্চা ছিল। এবং ভাষার দর্জিগিরি শুরুর আগে থেকেই তা বহমান ছিল। দেবেশ রায় তাঁর সামায়িকপত্রে বাংলা গদ্য বিষয়ক আলোচনায় প্রাচীন বাংলা গদ্যের আড়াই হাজার বিধি পাওয়ার প্রমাণ পেশ করছেন — আঠারশ সালের আগের। এবং সেই গদ্য সব সময় যে কাহিনী ছিল তাও নয়। জমিদার চিঠি পাঠাচ্ছে নায়েবের কাছে, নায়েব তার জবাব দিচ্ছে, বিবিধ সামাজিক আদান প্রদান, কন্যার বিবাহ নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি। আরও পেছনের দিকে গেলে সিরাজউদদৌলারও একশ বছর আগের দলিল পাওয়া যাচ্ছে। সেখান থেকে উদ্ধৃত করি : জনৈক নরহর এবং তার স্ত্রী দেবানাম্নী দাসীর কথা। নরহর বলছে মহাজনকে: আমি অমুক, আমার স্ত্রী দেবানাম্নী দাসী তোমার সহিত অন্নপহতি ও কর্জ্জপহতি নগদ নয় রূপাইয়া পাইয়া আত্মবিক্রয় হইলাম। এটাও তো গদ্য! অন্যদিকে মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে পালা-আখ্যানেও ন্যারেটিভ বিকশিত হচ্ছিল। এ দুইয়ে মিলেই জন্ম সম্ভব ছিল আধুনিক বাংলা আখ্যান সাহিত্যের এবং গদ্যেরও।

এখন এ প্রাচীন গদ্যের জায়গায় তাঁরা আমাদের শেখালেন নতুন গদ্য। তাহলে মাঝখানের যে সময়টাকে হারিয়ে দেওয়া হলো, সেটাকে বলতে চাই ভাষার বেড়ে ওঠার সময়, কৈশোরের সময়। আর কৈশোর হলো সেই সময় যখন একদিকে ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয় এবং স্বভাব-চরিত্র দাঁড়িয়ে যায়। সেই সময়টা আমাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হলো, আমাদের নিজেদের মতো করে বেড়ে উঠতে দেওয়া হলো না। মোদ্দা কথা এই যে, উপনিবেশবাদ হলো অধীনস্থ সংস্কৃতির নিজস্ব বিকাশ রহিত করার রাজনীতি। এখন আমরা আমাদের আমিত্বকে নিজের ভিতরে না খুঁজে, নিজের ইতিহাসে না খুঁজে, আমার প্রকৃতি ও আমার অভিজ্ঞতার যে জগত তার মধ্যে না খুঁজে অন্য কারো বয়ানে খুঁজছি। আর এটা শেখানোর গুরু-ভার নিল ইউরোপীয় আধুনিকতা ও ইউরোপীয় পুঁজিবাদ ইত্যাদি। আমরা এখন আত্মানুসন্ধানে ভয় পাই। আমরা আর নিজেদের কথা বলি না। আমরা বলি অন্যের কথা। কারণ অন্যের কথা বললে আমি পাস করবো, আমার অবস্থানটা নিরাপদ থাকবে।

এরকম একটা অবস্থায় সাহিত্যের একটা বড় কাজ হচ্ছে, হয় তথাকথিত সেই আধুনিকতাকে কুর্ণিশ করে সেটাকে আরও বিকশিত করে যাওয়া। নিজেদের লেজুড় অবস্থাটাকে আরও পোক্ত করে ফেলা; যাতে লেজ হিসেবে আমাকে কখনো খসিয়ে না ফেলা যায়। ঠিক যেমন টিকটিকি বিপদে পড়লে শত্রুর মুখে লেজ ছেড়ে পালায়! যেভাবে হেগেল বলেছেন যে, ইতিহাস হচ্ছে ইউরোপের; যাদের রাষ্ট্র আছে, যাদের ওই পরিমাণ বিকাশ ঘটেছে। আর বাকিরা হচ্ছে সেই ইতিহাসের লেজুড় বা উপাদান। এভাবে যারা ভাবতেন তাদের একজন হলেন নীরদ সি চৌধুরী। ব্রিটিশরা চলে গেলে তাঁরা কান্না জুড়ে দিলেন, হায় আমাদের সভ্যতার সূর্যও বোধহয় চলে গেল! আরও অনেকে আছেন। এমন কি বঙ্কিমচন্দ্রের নামও বলা যায়।

তাঁরা জাতকুলমান ছেড়ে ইউরোপের একটা সংস্কৃতিকে উপগ্রহ হিসেবে বঙ্গদেশের কর্দমাক্ত পরিবেশে আলো জ্বালানোর প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। যার নাম বঙ্গীয় রেনেসাঁ; ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও এনলাইটেনমেন্টের অনুকরণে। এটা যদি আধুনিকতা হয়, তাহলে সেই আধুনিতার ফল আমরা দেখছি। আমাদের আজকের এই শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবিকতা, গণতন্ত্র ইত্যাদি নানান সুন্দর সুন্দর জিনিসগুলো আমরা এরই মধ্যে পাবো। আর যে বাতিল মালগুলো; যাকে তথাকথিত আধুনিকতার খোপে পোরা গেল না, যেগুলো ঐ আধুনিকতার অগ্রযাত্রায় শামিল হলো না, সেগুলো পড়ে থাকলো অন্ধকারে। এসবের সঙ্গে শুধু জাতীয় অভিজ্ঞতাই পড়ে থাকলো না, এই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ইতিহাসবোধ-সমাজবোধ তথা তার আবেগের যে বিশেষ ধরণ, তার যে আত্মপ্রকাশের বেদনা, তাও পরিত্যাজ্য হলো। ত্যাজ্য জিনিসেরও স্থান সমাজে আছে, তাই তা হারিয়ে গেল না। সে বেদনাটা কিন্তু টিকে থাকলো ত্যাজ্যদের সমাজে অর্থাৎ নিম্নবর্গের জীবনে। এবং উৎসে ফেরার জন্য পরবর্তীকালে সাহিত্যিকরা তাকেই সন্ধান করতে থাকলেন। যে বিকাশ রেখাটা মুছে ফেলা হয়েছিল সেটাকে অনুসন্ধান করার অর্থ নিজেদের মুক্তি ঘটানো অর্থাত নিজের মধ্যে যে উপনিবেশায়ন ঘটেছিল, আমার আমিত্বকে যে আমি অপরের নামে চিনতে শিখেছিলাম; সেই জায়গা থেকে সরে এসে নিজের পরিচয় ঘোষণা করা, নিজের নাম ঘোষণা করা। তাহলে সংস্কৃতির লড়াই এর কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে সেই জায়গা খুঁজে বের করা, যেখানে নিজেদের ভাব ও অভাব দুটো নিয়েই আমরা দাঁড়াতে পারি। তাহলে কাজ হচ্ছে নিজের সেলফ বা আত্ম-কে, নিজের স্পিরিট বা চৈতন্যকে অনুসন্ধান করা। সেগুলোকে স্ব-স্বভাবে ফিরিয়ে আনা। এর মানে এই না যে, অতীতকে তুলে এনে আবার বর্তমানের ইঞ্জিনের সঙ্গে লাগিয়ে দিলাম বগি হিসেবে। এটা হয় না। মূলত সেটা আছে বর্তমানেও। সে কারণেই এই অনুসন্ধানটা দরকার।

এর প্রয়োজন হচ্ছে কেন? কারণ এ ছাড়া আমাদের সাহিত্যের স্বরাজ আসবে না। এ কারণে সংস্কৃতির লড়াইয়ে আমরা বারবার পরাজিত হচ্ছি বা ঠকে যাচ্ছি। রাজনৈতিকভাবে আমরা যে পরিমাণ জাতীয়তাবাদী ভাব ধরি, চিন্তার মধ্যে সংস্কৃতির মধ্যে, বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে আমরা সেই পরিমাণই পরাজিত ও পরজীবি হয়ে থাকি। আমাদের সম্পদ হলো আমাদের ভাষা, তা মধ্যবিত্ত ২০/৫০ লাখ নর-নরনারীর ভাষা না, ১৪ থেকে ১৫ কোটি লোকের মুখের ও মনের ভাষা এবং বিশ্বজুড়ে অন্তত ২৫ কোটি বাঙালির ভাষা। এর বয়স প্রায় হাজার বছর। কাজেই এই ভাষার ভাণ্ডারে যে অভিজ্ঞতা রয়েছে, সে শব্দাবলী রয়েছে, ইতিহাসের যে স্মারক রয়েছে, নানান রকমের আবেগের বহুমাত্রিক প্রকাশের যে ছাপ রয়েছে তা যদি একত্র করতে না পারি, ব্যবহার করতে না পারি, তাহলে সে ভাষা বা সাহিত্য নির্জীব এবং নিরুত্তাপ শব্দের মিছিল ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্রথমদিকে আমরা চেয়েছিলাম আধুনিকতার নামে ইউনিভার্সেল বা বিশ্বজনীন হতে। সে সময় বিশ্বজনীন হওয়ার অর্থ দাঁড়িয়েছিল ঔপনিবেশিক প্রভু-সংষ্কৃতি রপ্ত করা। কেউ কেউ অবশ্য ইউনিক হওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। এবং এই দোলাচালটা বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যেও পাওয়া যায়। দেবেশ রায়ের বিশ্লেষণ অনুসারে, উনি প্রথমদিকে লিখেছেন ব্রিটিশ সাহিত্যিক স্যার ওয়াল্টার স্কট এর অনুকরণে; অরণ্য-পাহাড়-পর্বতের মধ্যে রাজপুরুষদের অভিযান ও রোমান্সের ঘনঘটাজালে আবিষ্ট উপন্যাস সেসব। সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে দুর্গেশনন্দিনীকপালকুণ্ডলা এসব লিখলেন। কিন্তু তিনিও পারলেন না। কারণ বঙ্কিমচন্দ্র চাচ্ছিলেন সমাজে একটা নতুন পরিবর্তন, জাগরণ। কিন্তু সে জাগরণের রসদ তো বর্তমান থেকে ৩০০ বছর পিছিয়ে রাজকাহিনীর মধ্যে পাওয়া সম্ভব ছিল না। উপন্যাস সর্বদা বর্তমানের হাত ধরে হাঁটার চেষ্টা করে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় আমাদের প্রথম আধুনিক উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাদের হাত ধরে হাঁটিয়ে নিলেন ষোল কি সতের শতকের আলো-আঁধারির পরিবেশে। অতএব, বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাসটি দাঁড়াল পুরাকালের ওপর। অথচ তার আগে আলালের ঘরের দুলাল লেখা হয়েছিল সেই সময়ের কলকাতার জনজীবনের পরিস্থিতি নিয়ে এবং তার মধ্যে প্রবেশ করে। বঙ্কিম চেয়েছিলেন কমলাকান্তের দপ্তরে তিনি সমকালে ফিরবেন। কিন্তু এটা তো প্রবন্ধগুচ্ছ। কমলাকান্ত চরিত্রটি যেখানে-সেখানে যেতে পারে, সবকিছু নিয়ে কথা বলতে পারে। তার যে সর্বগামিতা ও ধারণক্ষমতা সেটা উপন্যাসের আদলে না হলে সম্ভব হতো না। কিন্তু সাহস পেলেন না একে উপন্যাস বলবার। অথচ তাতেই প্রমাণ হচ্ছে যে ভিন্ন একটা আকুতি গোড়া থেকেই ছিল। কিন্তু তা ফলতে অনেক দেরি হলো। গোড়ার দিকের উপন্যাস পারিবারিক বা সামাজিক আখ্যানে ভরপুর রইলো। রাষ্ট্র-রাজনীতি-ইতিহাসের গতি তাতে ঠাঁই পেল না।

উপন্যাসের সঙ্গে ইতিহাসের একটা সমান্তরালতা রয়েছে। ইতিহাসকে যে অর্থে অবজেকটিভ বলা হয় উপন্যাস সেই অর্থেই সাবজেকটিভ। তাকে মানবীয় অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে, জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার প্রবাহকে ব্যবহার করে বলবার কথাটি ফলিয়ে দেখাতে হয়। তা দেখাতে গিয়ে লেখককে হয় প্রচলিত উচ্চবর্গের নির্মিত ইতিহাস ও সমাজদৃষ্টির প্রতিধ্বনি করতে হয়, কিংবা তার বাইরে অন্য এক ইতিহাস কাঠামোর দিশা খুঁজতে হয়। সে ইতিহাস কাঠামোয় গরিব-গুর্বো মানুষ, বৃহত্তর কৃষকসমাজ, শহুরে মজুর-মধ্যবিত্ত সহ জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশের টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে যে গতি-দুর্গতির ব্যকরণ দাঁড়িয়ে যায়, তাকেই বলা যায় স্বতন্ত্র মানস ও ইতিহাসকাঠামো। একে আমলে না নিলে ঐ কাজ সম্ভবে কুলায় না। ব্যক্তির মনের একান্ত বিকারকেও বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে একটা সাপেক্ষ সম্পর্ক ছাড়া দেখলে পূর্ণ আয়তনে দেখা কঠিন হয়। এখানেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আবির্ভাবের শর্ত তৈরি হয়ে ছিল।

তিনি উচ্চবর্গের সাহিত্য রুচির বাইরে যাওয়ার জন্য উচ্চবর্গের জাতীয়তাবাদী আধুনিকতাবাদী প্রকল্পে সংশয় করে এখানকার ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার নিজস্ব গতিসূত্র খুঁজতে গেলেন দুটি মাত্রায়। ইতিহাস ও ভুগোল হলো সেই দুই মাত্রা। এর জীবনযাপন করা নিম্নবর্গীয় মানুষ হলো তাঁর বিষয়। তবে কি, কোনো লেখকই আসলে আকাশ থেকে পড়েন না! তিনি আসলে নিজের ভাষার আগেকার ধারা বা ট্র্যাডিশনের কোনো একটির ওপর সওয়ার হয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন বিহারীলালকে খুঁজে বের করেছিলেন, ইলিয়াসকেও তেমনি তাঁর পূর্বসুরীদের অভিজ্ঞতা থেকে নিতে হয় শিখতে হয়। নিজেকে একটা ট্র্যাডিশনের মধ্যে ফেলে তবে সেই ট্র্যাডিশনকে উত্তরিত করতে হয় নতুন স্তরে। কিন্তু আমরা দেখছি, অতীতকে নবায়ন করা হচ্ছে, অতীতের বৈপ্লবিক পরিবর্তন নয়। তারাশঙ্করের হাঁসুলি বাঁকের ইতিকথা-র বনওয়ারি বা করালীর সঙ্গে ইলিয়াসের খোয়াবনামা-র তমিজ কি তমিজের বাপের চেহারা-চরিত্র মিলে যায় বলে মনে হয়। অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস-এ সে সুবল বা কিশোর, পদ্মানদীর মাঝি-তে কুবের কিংবা দেবেশের তিস্তাপারের বৃত্তান্তে সে-ই আবার বাঘারু হয়ে আসে। কিন্তু ব্যাখ্যান ও তাৎপর্য বদলে যায়। এভাবে উপন্যাসে উপন্যাসে চালাচালি হয়ে জাতীয় আখ্যান রচনার সংস্কারকাজ চলতে থাকে। এর মধ্যে একটা উল্লম্ফন ঘটান আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর খোয়াবনামা-য়। হাঁসুলি বাঁকের ইতিকথা থেকেপদ্মানদীর মাঝিতিতাস একটি নদীর নামগড়শ্রীখণ্ড পর্যন্ত যে নবায়নের তোড় দেখি তিস্তাপারের বৃত্তান্তে চলে তার রূপান্তর। এভাবে আগের ধারা থেকে একটা ছেদ ঘটছে। ছেদ না হলে নতুন যাত্রা শুরু হবে কী করে?

পরের পর্বে সমাপ্য

           
পোস্ট কিংবা মন্তব্যে প্রকাশিত মতামত কোন অবস্থাতেই মুক্তাঙ্গন কর্তৃপক্ষের মতামতের প্রতিফলন নয়। বক্তব্যের দায়ভার লেখক এবং মন্তব্যকারীর নিজের। শুধুমাত্র "মুক্তাঙ্গন" নামের আওতায় প্রকাশিত বক্তব্যই ব্লগের যৌথ অবস্থানকে নির্দেশ করে।


http://www.nirmaaan.com/blog/faruk-wasif/309



আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
জন্মআখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস
১১ জুলাই, ১৯৩৬
জন্মের স্থানগোটিয়া গ্রাম, সাঘাটা থানা, গাইবান্ধা জেলা,বাংলাদেশ
মৃত্যু৪ জানুয়ারি, ১৯৯৭
মৃত্যুর স্থানআজিমপুর, ঢাকা
পেশাশিক্ষকতা, সরকারি কর্মকর্তা
যে কারণে পরিচিতঔপন্যাসিক

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (ফেব্রুয়ারি ১২১৯৪৩ - জানুয়ারি ৪১৯৯৭) একজন বাংলাদেশী কথাসাহিত্যিক। তিনি একজন স্বল্পপ্রজ লেখক ছিলেন। দুইটি উপন্যাস, গোটা পাঁচেক গল্পগ্রন্থ আর একটি প্রবন্ধ সংকলন এই নিয়ে তাঁর রচনাসম্ভার। বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ তাঁর রচনাকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী সুষমা।[১] বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পরেই তিনি সর্বাধিক প্রশংসিত বাংলাদেশী লেখক।[২]


সূচিপত্র

 [আড়ালে রাখো]

[সম্পাদনা]প্রাথমিক জীবন

আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস ১৯৪৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম মঞ্জু। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়। তাঁর বাবা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (১৯৪৭-১৯৫৩) এবং মুসলিম লীগে পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী ছিলেন।[৩]তাঁর মায়ের নাম বেগম মরিয়ম ইলিয়াস।আখতারুজ্জামান বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন (১৯৬৪)।

[সম্পাদনা]কর্মজীবন

আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াসের কর্মজীবন শুরু হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে। এরপর তিনি মিউজিক কলেজের উপাধ্যক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ডের উপ পরিচালক, ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। কর্মজীবনে আখতারুজ্জামান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। [৪] ১৯৭৩ সালে তিনি বিয়ে করেন । তাঁর স্ত্রীর নাম সুরাইয়া তুতুল।মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন, গোপনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তাঁর লেখা প্রতিশোধ, অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারি, মিলির হাতে স্টেনগান, অপঘাত, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, রেইনকোট প্রভৃতি গল্পে পরোক্ষ বা প্রতক্ষ্যভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা।১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলেও সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে বাকশালে যোগ দেওয়ার চাপ থাকলেও যোগ দেননি।

[সম্পাদনা]সন্মাননা

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন, "কি পশ্চিম বাংলা কি বাংলাদেশ সবটা মেলালে তিনি শ্রেষ্ঠ লেখক।" লিখেছেন, "ইলিয়াস-এর পায়ের নখের তুল্য কিছু লিখতে পারলে আমি ধন্য হতাম।" ইমদাদুল হক মিলন বলেনঃ"গত ১৫-২০ বছরের মধ্যে তাঁর এ দুটি উপন্যাসকে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।"[৫] ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। ১৯৯৬ সালে আনন্দ পুরষ্কারে ভূষিত হন। সারা জীবন লড়াই করেছেন ডায়াবেটিসজন্ডিস সহ নানাবিধ রোগে।১৯৯৭ সালের ৪ঠা জানুয়ারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ক্যন্সার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

[সম্পাদনা]গ্রন্থতালিকা

[সম্পাদনা]উপন্যাস

[সম্পাদনা]ছোট গল্প সংকলন

[সম্পাদনা]প্রবন্ধ সংকলন

  • সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু (২২টি প্রবন্ধ)

[সম্পাদনা]পুরস্কার

তাঁর কিছু কাজ অন্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং চিলেকাঠার সেপাই উপন্যাসটি অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।

[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র

  1. http://whoiswho.evergreenbangla.com/%E0%A6%86%E0%A6%96%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%87%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B8/
  2.  http://www.bengaliwiki.com/page/Akhtaruzzaman+Elias
  3.  http://www.banglapedia.org/httpdocs/HT/E_0044.HTM
  4.  http://www.choturmatrik.com/blogs/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%89%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B6%E0%A7%8B/%E0%A6%86%E0%A6%96%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%87%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B8-%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9C%E0%A6%A8-%E0%A6%B8%E0%A7%8E-%E0%A6%93-%E0%A6%85%E0%A6%A4%E0%A7%83%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%A4-%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%95
  5.  http://forum.projanmo.com/topic2726.html

[সম্পাদনা]বহিঃসংযোগ

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস – তাঁর সঙ্গ অনুষঙ্গ

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস – তাঁর সঙ্গ অনুষঙ্গ
মহীবুল আজিজ

পাইপসমেত দুজন মানুষকে কখনই ভুলতে পারি না। তাঁদের একজন অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অন্যজন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। পাইপসংক্রান্ত গৌরচন্দ্রিকাটুকু প্রথমেই সেরে নেওয়া যাক। বর্তমান লেখাটা দ্বিতীয় জনকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখি ১৯৭২-এ। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জনসভায়, বাবার কাঁধে চড়ে দেখতে হয়েছে তাঁকে। তখন পাইপ দেখেছি কি না মনে নেই। কিন্তু দ্বিতীয় ও শেষবার ১৯৭৫ সালের পয়লা আগস্ট তারিখটি এখনো দপদপ করে জ্বলছে। আমরা সরকারি মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্ররা স্কুলের খেলার মাঠ লালদীঘি ময়দানে জড়ো হয়েছি। বঙ্গবন্ধু যাবেন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধনে। মঞ্চ তৈরি হয়েছে ময়দানে। আমাদের হাতে সজ্জিত রংবেরঙের মালা। আমার এক ক্লাস নিচে ছিলেন আজকের বিখ্যাত গায়ক আইয়ুব বাচ্চু এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হাসান মাহমুদ। ছিলেন তাঁরাও। সবটা সময় মঞ্চের সন্নিকট থেকেই দেখলাম। অপার মুগ্ধতা আর বিস্ময় নিয়ে সেই দেখা। সেই শেষ কিন্তু এখনো দাঁড়িয়ে আছেন তিনি পাইপ হাতে, বক্তৃতারত—ইতিহাসের বরপুত্র।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে আমি চিঠি লিখি ১৯৮৬-র জুলাই মাসে। উদ্দেশ্য, লিটল ম্যাগাজিন নামক ছোট কাগজের প্রথম সংখ্যার জন্য ছোটগল্প বিষয়ে একটি মিনি সাক্ষাত্কার নেওয়া। ২০-৭-১৯৮৬-তে ১২/৩ কে এম দাশ লেন, টিকাটুলি, ঢাকা-৩ থেকে চিঠি আসে তাঁর লেখাসহ, সেই সঙ্গে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ। চার পৃষ্ঠার সেই প্রশ্নোত্তর এখন আমারই সামনে রয়েছে। তিনি লিখেছেন, 'ব্যক্তিকে স্থাপন করতে হয় সমাজের প্রেক্ষিতেই, ব্যক্তির ভেতর দিয়ে সমাজ বিকশিত হয়, আবার সমাজ গড়ে তোলে ব্যক্তিকে'—ইত্যাদি। চিঠির মানুষটাকে এরপর দেখতে পেলাম কাছ থেকে। বহুবার বহু প্রসঙ্গে তাঁর কাছে গিয়েছি, অপ্রসঙ্গেও গিয়েছি। বাংলা উপন্যাসের অবিসংবাদিত এ স্রষ্টার সঙ্গে সময় কাটাবার লোভ—আমার মতন অনেকের কাছেই ছিল একদিন মহার্ঘ। এত দিন পরও দেখতে পাচ্ছি কে এম দাশ লেনের বেঙ্গল স্টুডিওর পেছনে হুমায়ুন সাহেবের বাড়ির গেটে দাঁড়ানো ইলিয়াস বলছেন, 'এসো কিন্তু!'
টিকাটুলিতে হাড়ের ডাক্তার মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়িটি আমাদের জন্য অচিরে একটি তীর্থস্থান হয়ে দাঁড়ায়। ইলিয়াসের উপস্থিতিতে সারাক্ষণ আলো ছড়াত পুরান ঢাকার এ বাড়িটি। হয়তো ইলিয়াসের অনেকটা সময় ছিনতাই করে নিয়েছি আমরা তরুণেরা কিন্তু তিনি সর্বদাই ছিলেন দানপ্রবণ। পৃথিবীর তাবত্ বিষয়ে আড্ডায় মেতেছি আমরা, সমৃদ্ধ হয়েছি, স্নাত হয়েছি। দুহাত বাড়িয়ে সবাইকে তিনি গ্রহণ করেছেন, কখনো কোনো কুণ্ঠাবোধ তাঁকে সিটিয়ে দেয়নি। অথচ এসবের ভেতরেই নিভৃতে গাঁথা হয়ে যাচ্ছে কাত্লাহার বিলের কাহিনি কি ইলিয়াসীয় গল্পাবলি এবং টান টান প্রবন্ধসমুচ্চয়।
আমার নিবাস চট্টগ্রাম, সে সূত্রে সৌভাগ্য খানিকটা আমার দিকে ঝুঁকেছিল। মনে পড়ে একবার তাঁকে খুব খেপিয়ে দিয়েছিলাম। উপন্যাসটা প্রথমে পড়ি সাপ্তাহিক রোববার-এ চিলেকোঠা নামে, পরে হলো চিলেকোঠার সেপাই। পাঠ-অভিজ্ঞতার সূত্রে প্রশ্ন করেছি, 'আপনার হাড্ডি খিজির অত গালিগালাজ করে কেন?' দুম করেই উত্তর দেন তিনি, 'কিসের গালিগালাজ ওইটা তো ওর ভাষা! আর ওর আসল ভাষা কেড়ে নিয়েছি আমরাই!' ঢাকা থেকে ফিরে আসি এবং ২৩-৪-১৯৮৭ তারিখে লেখা তাঁর সেই বিখ্যাত চিঠি এসে পৌঁছায় এ অভাজনের কাছে। চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাস এবং এতে হাড্ডি খিজিরের স্ল্যাং এবং আনোয়ারের পরিণতি সম্পর্কে তাঁর নিজের ভাষ্য। সে চিঠি এখন অমূল্য সম্পদ এবং ইলিয়াস-সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে অমোঘ সহায়ক সূত্র। শুধু দুইটা লাইনেই ইলিয়াসের বক্তব্যের তীব্রতা ঝলকে ওঠে, 'শোষণের চাপে তাদের ভেতরটা এমনভাবে কুঁকড়ে গেছে যে সেই গ্লানি বা তিক্ততায় কখনো প্রতিরোধে ফুঁসে উঠতে পারে না। বড় জোর ক্ষোভে পরিণত হয়। এই তিক্ততা, ক্ষোভ ও গ্লানি বের করার নালা হলো তাদের খিস্তিখেউড়ের চর্চা।' সাহিত্য তাঁর কাছে ফ্যাশনের বস্তু ছিল না, ছিল রক্ত-ঘাম ঝরানো সৃজনকর্ম। তখন যাঁরা তাঁর সংস্পর্শ পেয়েছেন, কথাশিল্পী কায়েস আহমেদ, গল্পকার মামুন হুসাইন, সুশান্ত মজুমদার, শিল্পী ঢালী আল মামুন, ইলিয়াসের বন্ধু মাহবুবুল আলম জিনু, অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ এ রকম আরও অনেকেই, আমাদের সবার কাছেই ইলিয়াসের যেকোনো রচনা ছিল আগ্রহের বিষয়।
কেবল নিজের লেখা নয়, অন্যের লেখা সম্পর্কেও সিরিয়াস ছিলেন ইলিয়াস। বিশেষ করে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ এবং সমকালীনদের সম্পর্কে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মতামত পাওয়া যেত। নির্গ্রন্থ মামুন হুসাইনের গল্প তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। ইলিয়াস অকুণ্ঠে জানান, মামুনের গল্পগ্রন্থ বের হওয়া দরকার। আহমদ বশীরকে নিয়েও তাঁর প্রত্যাশা ছিল, যদিও এঁকে আর লেখালেখিতে দেখা যায় না। মনে পড়ে জনৈক তরুণ কথাশিল্পী তাঁর একটি উপন্যাস পাঠান ইলিয়াসের কাছে, মূল্যায়ন ও মতামত চেয়ে। ইনি পরে বেশ কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কার পান এবং বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত কথাসহিত্যিক। সাহিত্যের বেলায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন পারফেকশনিস্ট। তাঁর ঘরের একটি সাইড-টেবিলে প্রায়ই দেখতাম একটি উপন্যাস রাখা—মিগুয়েল সার্ভান্তেসের দোন কিহোতে। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস। মাঝেমধ্যে বলতাম সার্ভান্তেস হচ্ছে তাঁর বাইবেল।
সার্ভান্তেসের সদর্থক প্রভাবও হয়তো ইলিয়াসে বর্তেছে খানিকটা। আমার প্রথম গল্পগ্রন্থের দ্বীপবাসীদের গল্প-এর বর্ণনভঙ্গি তাঁর ভালো লেগেছিল। পরামর্শ দিয়েছেন, ভবিষ্যতে উপন্যাস লিখলে যাতে এর ভঙ্গিটি ব্যবহার করি। ঢাকা থেকে ১৬-১২-১৯৯০-এ লেখা চিঠিতে তিনি জানান, 'চতুরঙ্গ পত্রিকার নভেম্বর সংখ্যায় তোমার "গ্রাম উন্নয়ন কমপ্লেক্স ও নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ"-এর একটি ছোট আলোচনা বেরিয়েছে। …পত্রিকাটি থেকে ক্লিপিং পাঠালাম।' আমার বই কলকাতায় পাঠান তিনিই। অন্যের মূল্যায়নে যাঁর এত উত্সাহ, সেই তিনিই লিরিক-এর বিষয়ে ছিলেন দারুণ নিরাসক্ত। আমাদের বন্ধু এজাজ ইউসুফীকে সে লিরিক-ইলিয়াস সংখ্যা প্রকাশে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সেটা এজাজই জানে, আর জানি আমরা কজন। তাঁর প্রতি তরুণতরদের উত্সাহকে কিন্তু তিনি মূল্য দিতেন। লিরিক প্রকাশের পর একটি চিঠিতে (২৭ মার্চ ১৯৯৩) তাঁকে পাচ্ছি—
'চট্টগ্রামে লিরিক গত বছর আমার ওপর একটি বিশেষ সংখ্যা বের করেছে, সেখানে তোমার একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা রয়েছে। ওখানে আমার একটি উপন্যাস খোয়াবনামার একটুখানি অংশ ছাপা হয়েছে, তিন মাস ধরে আমি দিনরাত ওই উপন্যাসের ওপরেই কাজ করে চলেছি। কিন্তু উপন্যাস আর এগোয় না। চতুর্থ অধ্যায় লেখার পর দ্বিতীয় অধ্যায় ফের লিখতে শুরু করলাম, সেটা শেষ হলো তো নতুন করে ধরলাম তৃতীয় অধ্যায়। লেখাটা ভালো হচ্ছে না, কিন্তু লিখতে আমার ভালো লাগছে।'
ঠাট্টা, ব্যঙ্গ এসব তাঁর স্বভাবের এবং লেখার বৈশিষ্ট্য বলেও মানুষের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ। মানুষের কাজের নিরিখে তাকে সঠিক মূল্য দিতে তিনি পিছপা হতেন না। সমকালীন লেখক হাসান আজিজুল হক এবং শওকত আলী সম্পর্কে সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন করতে শুনেছি তাঁকে। বলতেন, 'হাসান ভাইয়ের লেখার যেদিকটা আমার সবচাইতে ভালো লাগে, তা হলো তাঁর উদ্দেশ্যের স্পষ্টতা। তিনি জানেন যে লেখাটা কতদূর পৌঁছাচ্ছে।' কিংবা শওকত আলী সম্পর্কে, 'আরও সময়নিষ্ঠ হয়ে লিখলে হয়তো শকওত ভাই আমাদের ইতিহাস এবং সমাজের অনেক অকথিত দিক তুলে আনতে পারবেন।' সৈয়দ হক সম্পর্কে বলেছেন, 'সৈয়দ হক নগরটাকে চেনেন, এর জটিলতা, এর অভদ্রতা-ইতরামির চেহারাটা তাঁর জানা।' ইলিয়াস খুব ভক্ত ছিলেন অভিজিত্ সেনের বহু চণ্ডালের হাড় উপন্যাসের এবং মহাশ্বেতা দেবীর চেট্টি মুণ্ডা ও তার তীর এবং আরও কয়েকটি উপন্যাসের। দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত উপন্যাসের প্রশংসাও শুনেছি তাঁর মুখে। মানুষের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণেই একেবারে নামপরিচয়হীন মানুষটিকেও তিনি মূল্য দিতে জানতেন। গৃহপরিচারিকার সংসার-স্বজনের খবর নিতেন তিনি অত্যন্ত মনোযোগসহকারে। পুরান ঢাকার হোমিও চিকিত্সক ডাক্তার নেইমান, জনৈক ঘড়িমেরামতকারী কিংবা কোনো এক জুতা সেলাইওয়ালার কাহিনি এত ডিটেলসহ বলতে থাকেন যে মনে হয় এই ডাক্তার, এই মেকার এবং এই কবলার এঁরা সমাজের খুবই গুরুত্বধারী ব্যক্তিত্ব।
১৯৯০-তে তাঁকে নিয়ে যাই চট্টগ্রাম, বাঁশখালী, চকরিয়া সফরে। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সেই সাংস্কৃতিক সফরের কান্ডারি ছিলেন অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন আহমদ। আসহাবউদ্দিনের বাড়ি সাধনপুরে শীতের সকালে আমাদের ভাগে পড়ল নানা ধরনের পিঠে। একটা বিশেষ ধরনের পিঠের নামে বেশ আকৃষ্ট হলেন তিনি—'আতিক্কা পিডা'। অতঃপর আমাকে জেনে নিতে হলো সে পিঠের প্রস্তুতপ্রণালি ও নামকরণের হেতু। চট্টগ্রামে 'আতিক্কা' শব্দের অর্থ 'হঠাত্' বা 'আচমকা'। ঘরে মেহমান এলে স্বল্প উপাদানযোগে দ্রুত তৈরি করা যায় বলে পিঠার নাম 'আতিক্কা পিডা'। আমি কৌতুক করে বলি, 'নিশ্চয়ই কোনো লেখায় ঢোকাবেন!' আসলে চির কৌতূহলী ইলিয়াস জানার মধ্যে কোনো ফাঁক রাখতেন না।
চট্টগ্রামের কথা উঠল। ১৯৯০-এ তিনি দুবার চট্টগ্রামে আসেন—প্রথমবার বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাংগঠনিক সফরে, সম্ভবত জুলাইয়ে এবং দ্বিতীয়বার অক্টোবরে লেখক শিবিরের সপ্তম দ্বিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলনে। সাংগঠনিক সফরে আরও আসেন বদরুদ্দীন উমর, হাসান আজিজুল হক ও আনু মুহাম্মদ। সাংগঠনিক ব্যস্ততার অবসরে তাঁর ইচ্ছেমতো আমরা ঘুরে বেড়াতে থাকি চট্টগ্রামের নানা জায়গায়, পতেঙ্গায়, বাটালি হিলে, ফয়'স লেকে। প্রসঙ্গক্রমে আমি তাঁর 'যুগলবন্দী' গল্পের কথা ওঠাই। সাপ্তাহিক রোববারে প্রথম পড়ি, পরে এটি ছাপা হয় দোজখের ওম গল্পগ্রন্থে। এটি চট্টগ্রাম শহরের প্রেক্ষাপটে লেখা—বন্দর, কাস্টমস, রিয়াজুদ্দিন বাজার, মাদারবাড়ি, স্ট্যান্ড রোড, স্টেশন রোড, কর্ণফুলী—এসব প্রামাণ্যভাবেই আছে গল্পে। তাঁকে বলি, চট্টগ্রাম শহরের সহায়তা পেলেন কীভাবে? জানালেন, সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে তিনি চট্টগ্রাম আসেন ছোট ভাই প্রখ্যাত অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের বিয়ে উপলক্ষে। খালিকুজ্জামানের স্ত্রী পারভীন জন্মসূত্রে ভারতীয়, অবাঙালি। কিন্তু কি ইংরেজি কি বাংলা উভয়ে পারভীনের দখল অসামান্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া পারভীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি করেন জোসেফ কনরাড এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লহর উপন্যাসের তুলনামূলক বিচার বিষয়ে। ইলিয়াসের উত্সাহে খুঁজে বের করা গেল মাঝিরঘাটের পারভীনদের বাড়ি। সম্ভবত ওর মা তখনো বেঁচে ছিলেন। ইলিয়াস ভাই এবং আমাকে স্বল্প সময়ের জন্য পেলেও বেশ আপ্যায়ন করলেন তাঁরা। ইলিয়াস বলেন, চট্টগ্রামের ছবি ভেসে উঠলেই শহরের এদিকটার কথাই মনে পড়ত। বেশ খোলামেলা, পুরোনো পুরোনো, অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট, বাড়ির দোতলা থেকেও সদরঘাটের, কর্ণফুলীর জাহাজের মাস্তুল চোখে পড়বে। তত দিনে চট্টগ্রাম যথেষ্ট বদলালেও মাদারবাড়ি, মাঝিরঘাট কি সদরঘাটের দিকটা বহুদিন প্রায় একই রকম থেকে যায়।
নব্বইয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একাধিকবার চট্টগ্রামে আসাটা এখানকার তরুণ সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মীদের বেশ অনুপ্রেরণা জোগায়। মনে রাখতে হবে, তখন দেশজুড়ে স্বৈরাচার এবং বিরোধী আন্দোলন চলছে সমান্তরালে। চট্টগ্রামের নানা স্থানে সাহিত্যের আড্ডাগুলোও জমজমাট। এত যে নিয়ন্ত্রণ, এত যে বিধিনিষেধ তবু আমাদের আড্ডাপ্রাবল্যকে ঠেকানো যায় না। ইলিয়াস এবং হাসান দুজনকেই আমরা নিয়ে যাই বাংলা বিভাগে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। তখন বিভাগীয় সভাপতি অধ্যাপক খালেদা হানুম। বাংলা উপন্যাস প্রসঙ্গে। সামাজিক বিবর্তন, ব্যক্তির অবস্থান এবং ঔপন্যাসিকের দর্শন—এসব বিষয় মুখ্য হয়ে ওঠে আলোচনায়। কিন্তু সব ছাপিয়ে তরুণদের সঙ্গে গড়ে ওঠে এক সখ্যসেতু। ইলিয়াস উত্সাহী হয়ে ওঠেন চট্টগ্রামে তরুণদের আড্ডা সম্পর্কে। এক সন্ধ্যায় তাঁকে নিয়ে গেলাম চকবাজারের সবুজ আড্ডায়। অদ্ভুত ব্যাপার, পাশের টেবিলে দেখি পরিচিত এক ডিআইবির লোক। তাঁকে নিম্নস্বরে বলি, ভাই, এখনই আমরা সরকারকে টেনে নামাচ্ছি না। ভদ্রলোক বলেন, ভাই, চাকরি! সবুজ তখন আড্ডারুদের তাপে উত্তপ্ত। হাফিজ রশিদ খান, এজাজ ইউসুফী, আহমেদ রায়হান, জিললুর রহমান, খালেদ হামিদী এবং এঁদের কিছুক্ষণ পরেই এসে পড়েছেন জাফর আহমদ রাশেদ, রাজীব নূর, পুলক পাল এবং মাঝেমধ্যে অলকা নন্দিতা কিংবা তনুজা শর্মা। সাজিদুল হক, শাহীনুর রহমান, হাবিব আহসান, সিরাজুল হক সিরাজ এ রকম কত মুখ। ইলিয়াসকে ঘিরে সেই সন্ধ্যায় ক্লান্তিহীন আড্ডা হলো। এই 'আড্ডা'র যোগাযোগেই এজাজ ইউসুফীর লিরিক-ইলিয়াস সংখ্যার উত্থাপনা। এটা খুব গৌরবের ব্যাপার যে ইলিয়াসের মতো একজন মহান ঔপন্যাসিকের সাহিত্যের মূল্যায়নের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নেয় চট্টগ্রাম। সেদিন এবং পরে নানা সময়ে দেখেছি লিরিক বিষয়ে কথা উঠতেই ইলিয়াস তরুণ পাঠক শ্রেণীর কথাই বলতেন। প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক-সমালোচক নয় এখনকার তরুণ লেখক-পাঠক ইলিয়াস-সাহিত্য বা চিলেকোঠার সেপাই পড়ে কীভাবে সেটা লিরিক-এর বিবেচ্য হওয়া উচিত। লিরিক ইলিয়াস সংখ্যা নিশ্চয়ই তাঁর মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে পেরেছিল। আরও উল্লেখ্য, ইলিয়াসের সবুজ-আড্ডায় উপস্থিতির কালে জাফর আহমদ রাশেদ উঠতি তরুণ। পরবর্তী সময় স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে তাঁর গবেষণার বিষয় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্প যেটি আরও পরে (২০০১) প্রকাশ পায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্প: জীবনোপলব্ধির স্বরূপ ও শিল্প নামে। তা-ও চট্টগ্রামের গৌরব। তখন ইলিয়াস-সাহিত্য পাঠ্যসূচিতে ছিল না। কিন্তু রাশেদের গবেষণাকর্মটি একদিক থেকে পথিকৃতের ভূমিকার অহংকার করতে পারে। আজ বাংলাদেশের নানা প্রতিষ্ঠানে এবং পশ্চিমবঙ্গে ইলিয়াস-সাহিত্যের অধ্যয়ন চলছে।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের টেবিলে মিগুয়েল সার্ভান্তেসের দোল কিহোত-এর সার্বক্ষণিক উপস্থিতি লক্ষ করেছি। আমার টেবিলে রয়েছে খোয়াবনামা ও চেলেকোঠার সেপাই। নিশ্চয়ই আজকের তরুণ লেখকেরাও ইলিয়াস-সাহিত্যের উত্সাহী পাঠক। ইলিয়াস তরুণদের কদর করতেন, তরুণদের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন তিনি। কেননা, তিনি জানতেন, আজকের তরুণরাই একদিন চিলেকোঠা ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে বিস্তৃত আঙিনায়। ইলিয়াসকে ভাবতে গেলেই আমরা ফের তরুণ হয়ে উঠি এবং পাইপসমেত মানুষটিকে কখনই আর ভুলতে পারি না, যেমন ভুলতে পারি না বঙ্গবন্ধুকেও।

মহীবুল আজিজ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১২, ২০১০

Share

-- 

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-একজন সৎ ও অতৃপ্ত লেখক

২০ শে নভেম্বর, ২০১০ ভোর ৪:২০

শেয়ার করুনঃ
030



আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের নাম । তেতাল্লিশের মন্বন্তরে জন্ম নেওয়া এ শিল্পীর লেখায় ক্ষুধা-দারিদ্র-সংগ্রাম উঠে আসাটাই ছিলো স্বাভাবিক। তাঁর লেখায় ছিলো গভীর জীবনবোধ, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি ও ক্ষুরধার হিউমার। ক্ষুধায় কাতর রুগ্ন মানুষের বমি আর দুধভাতকে পাশাপাশি রেখে তিনি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ধনী-গরীবের ভেদাভেদ। তাঁর লেখা তাঁর মত করেই বলতে গেলে ঠিক যেনো আমাদের মস্তিস্কের কোটরে গিয়ে হাতুড়িপেটা করে। জীবনমুখী আবেদন, চরিত্র সৃষ্টিতে মুন্সীয়ানা ও আঞ্চলিক সংলাপের যথার্থ প্রয়োগ তাঁর লেখনীর উল্লেখযোগ্য দিক। ইলিয়াসের হাতের ছোঁয়ায় খিস্তি-খেউড়ও লাভ করতো শৈল্পিক রূপ।
জীবনভর লেখার জন্য হাপিত্যেশ করেননি, বরং লেখাই তাঁর পায়ে পায়ে ঘুরেছে। বণিকবুদ্ধির কাছে এক মূহুর্তের জন্যও বিকিয়ে দেননি তাঁর শিল্পসত্তা। তাই ইলিয়াসের সাহিত্য জীবন ২টি উপন্যাস, ৫টি গল্পগ্রন্থ ও ১টি প্রবন্ধ সংকলন ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার সংকলনে এসে থেমে যায়। কিন্তু আমাদের দেশের সাহিত্যভান্ডারে তিনি হীরার খনি যার প্রতিটি লেখাই কালের বাজারে হীরার চেয়েও মূল্যবান।

নিজের সম্পর্কে ইলিয়াস বলতেন যে তিনি চব্বিশ ঘন্টার লেখক। তিনি বেঁচেছেন, পথ চলেছেন, মানুষের সঙ্গে মিশেছেন এই লেখকের চোখ নিয়ে। জীবনকে তিনি দেখেছেন একজন লেখকের চোখে, তাঁর সমগ্রতায়। 

 

সংক্ষিপ্ত জীবনী
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পুরো নাম আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস । ডাকনাম মঞ্জু। জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, তৎকালীন রংপুর ও বর্তমান গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার গোটিয়া গ্রামে। পৈত্রিক নিবাস ছিলো বগুড়ায়। পিতা বি এম ইলিয়াস ছিলেন বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি হাই স্কুলের হেডমাস্টার ও তৎকালীন বগুড়া জেলা মুসলিম লীগের সাধারন সম্পাদক। মাতা মরিয়ম ইলিয়াস। ইলিয়াস ছিলেন তাঁর ভাইদের মধ্যে সবার বড়।
১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন বগুড়া জেলা স্কুল থেকে। এরপর ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। বাংলা সাহিত্যে এম এ পাশ করেন ১৯৬৪ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ।
ইলিয়াস জগন্নাথ কলেজের প্রভাষক হিসেবে চাকুরি জীবন শুরু করেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে । কর্মজীবনে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ও ঢাকার সরকারি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন।
১৯৭৩ সালে বিয়ে করেন । স্ত্রী সুরাইয়া তুতুল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন, গোপনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। আর তাঁর প্রধান অস্ত্র কলমের যুদ্ধ তো ছিলোই। তাঁর লেখা প্রতিশোধ, অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারি, মিলির হাতে স্টেনগান, অপঘাত, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, রেইনকোট প্রভৃতি গল্পে পরোক্ষ বা প্রতক্ষ্যভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা।
১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে বাকশালে যোগ দেওয়ার চাপ থাকলেও যোগ দেননি।
১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। এছাড়া বিভিন্ন সময় ভূষিত হয়েছেন নানা পুরস্কারে।
সারা জীবন লড়াই করেছেন ডায়াবেটিস, জন্ডিস সহ নানাবিধ রোগে। শেষ পর্যন্ত মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকার আজিমপুরে মৃত্যুবরণ করেন এ বরেণ্য কথা সাহিত্যিক।

সাহিত্যকর্ম
উপন্যাস:
চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৬), খোয়াবনামা (১৯৯৬)
প্রবন্ধ সংকলন:
সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু-২২টি প্রবন্ধ (১৯৯৭)
গ্রন্থটিতে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত ২১ টি প্রবন্ধ ও ১টি অপ্রকাশিত বক্তৃতা সংকলিত হয়েছে।
গল্পগ্রন্থ:
অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬)
অন্তর্ভুক্ত গল্প : নিরুদ্দেশ যাত্রা, উৎসব, প্রতিশোধ, যোগাযোগ, ফেরারী, অন্য ঘরে অন্য স্বর ।
খোঁয়ারি (১৯৮২)
অন্তর্ভুক্ত গল্প : খোঁয়ারি, অসুখ-বিসুখ, তারা বিবির মরদ পোলা, পিতৃবিয়োগ।
দুধভাতে উৎপাত (১৯৮৫)
অন্তর্ভুক্ত গল্প : মিলির হাতে স্টেনগান, দুধভাতে উৎপাত, পায়ের নিচে জল, দখল।
দোজখের ওম (১৯৮৯)
অন্তর্ভুক্ত গল্প : কীটনাশকের কীর্তি, যুগলবন্দি, অপঘাত, দোজখের ওম।
জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল (১৯৯৭)
অন্তর্ভুক্ত গল্প : প্রেমের গপ্পো, ফোঁড়া, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, কান্না, রেইনকোট।

কিছু কথা:সম্প্রতি আমি মাওলা ব্রাদার্স কর্তৃক প্রকাশিত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর রচনাসমগ্র-১ (গল্পসমগ্র) পড়লাম। আমার মস্তিস্ক ও হৃদয় জুড়ে শুধুই মুগ্ধতা । তাঁর লেখাকে বিশ্লেষণ করার মত ধৃষ্টতা আর যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই। তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তাই ভাবলাম সংক্ষিপ্ত জীবনী আর সাহিত্যকর্ম তুলে ধরি। আর আমি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আবার পাড়ি জমালাম তাঁর লেখার জগতে। হাতে তুলে নিলাম রচনাসমগ্র-২।#

 

লেখাটির বিষয়বস্তু(ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড): সাহিত্য ;
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা 

ঈদ সংখ্যার একাল-সেকাল
0%
 
গড় রেটিং:
 
রেটিং :
শওকত আলী
দেশ বিভাগের আগে অর্থাৎ '৪৭-এর আগেই ঈদ সংখ্যা প্রকাশের চল ছিল। সাহিত্যচর্চা এবং সাহিত্যের অনুসঙ্গগুলো একত্র করে ঈদ সংখ্যার যে জাগরণ ঘটে_ পূর্ববাংলা অর্থাৎ তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে এসে দেখা গেল দিন দিন তা উজ্জ্বলতর হচ্ছে। এখানে এসে সাহিত্যচর্চার একটা জোয়ার দেখা গেল_ প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা হচ্ছে, ছাত্ররা কবিতার সংকলন বের করছে। তারপর আমি তখন কলেজে পড়ছি, সে সময়টায় ঈদ সংখ্যা বের হচ্ছে, সেখানে উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে, আলাউদ্দীন আল আজাদের লেখা পড়ছি, হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা পড়ছি, ১৯৫২ সালের দিকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কবিতাও পড়েছি। এভাবে ঈদকে ঘিরে ঈদ সংখ্যা বের হওয়ার ফলে তখনকার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে একটা জাগরণ ঘটে। তারা সারাবছর উন্মুখ হয়ে থাকে, কবে ঈদ সংখ্যা বেরুবে। এভাবে ঈদকে ঘিরে সাহিত্যের আসর সম্প্রসারিত হতে থাকে। আমার প্রথম উপন্যাস 'পিঙ্গল আকাশ' প্রকাশিত হয় মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্ সম্পাদিত 'পূবালী' পত্রিকায়। এর আগেই অবশ্য আমার দু'চারটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, এর মধ্যে কবিতাও ছিল। যাহোক ঈদ সংখ্যায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা গেল, অনেকে আমাকে চিনতে শুরু করেছে। এর মধ্যে মুনীর চৌধুরী উপন্যাসটির প্রশংসা করেছিলেন যেটুকু মনে পড়ে বেতারের কোনো একটা অনুষ্ঠানে। ফলে লোকজন আমার লেখালেখির ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠছিল। 
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলেও, এর আগেই মন-মানসিকতায় এবং চেতনার দিক থেকে এক প্রকার মুক্তি ঘটে গিয়েছিল, বিশেষ করে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। ফলে এ কথা বলা যায়, বাঙালির জাতীয় জাগরণের সঙ্গে ঈদ সংখ্যার একটা সম্পর্ক আছে। বাঙালিরা সচেতনভাবে যে জাগরণ ঘটাল, তার প্রতিফলন ঈদ সংখ্যাতেও ছিল। আর বাঙালির জাতীয়তার চেতনা সুস্পষ্ট হতে থাকত ওই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। সাহিত্য-সংস্কৃতির এই বিকাশ চেতনাকে ধীরে ধীরে স্ফীত করতে থাকল। 
স্বাধীনতার আগেই ঈদ সংখ্যার জাগরণ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আরও উচ্ছ্বসিত হলো। সে সময়ে ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হতে শুরু করায় বহু পুরনো লেখক_ যারা প্রায় লেখা ছেড়েই দিয়েছিলেন, তারা আবার লিখতে শুরু করলেন। আর আমরা যারা নতুন তখন লিখতে শুরু করেছি, তারাও ঈদ সংখ্যা ঘিরে ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে লিখতে শুরু করি। এসব বিষয় ঘিরে, সাহিত্যের একপ্রকার গতিময়তা অনুভব করে কারও কারও মগজে সিরিয়াস কিছু, বড় ধরনের কোনো কিছু লেখার চিন্তা আসতে শুরু করে। আমরাও ভাবতে থাকি বড় ধরনের লেখা লেখার। এ ধারাটা অব্যাহত ছিল পুরো সত্তরের দশক পেরিয়ে আশির দশক পর্যন্ত। জগন্নাথ কলেজে আমার সহকর্মী ছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ছাত্র ছিল কায়েস আহমেদ। কায়েস লিখতে চাইত না। আমরা চাপাচাপি করে তাকে লেখাতে বাধ্য করাই। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস 'চিলেকোঠার সিপাই' লেখেন, তারপর লেখেন 'খোয়াবনামা'। তখন আমাদের দু'জনের মধ্যেই ইউরোপের 'সুররিয়ালিজম' অর্থাৎ পরাবাস্তববাদের যে ধারণা তা খেলা করছিল। এ বিষয় আমাদের লোকবিশ্বাসের মধ্যে আছে, আমাদের ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে আছে, গ্রামে-গঞ্জে যে মেলা হয় তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে আছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার 'খোয়াবনামা' রচনা করেছেন কোনো কাল্পনিক ঘটনার ওপর নির্ভর করে নয়। এটা আমাদের গ্রামীণ জীবনের যে লোকবিশ্বাস, তার যে ধর্মচেতনা_ এগুলোর ওপর নির্ভর করে নির্মাণ করেছেন তার এ উপন্যাস। আমি আগেও বলেছি এবং এখনও বলছি, 'খোয়াবনামা'র মতো উপন্যাস পৃথিবীতে খুব কম লেখা হয়েছে। এটা বিশ্বসাহিত্যে যুক্ত হওয়ার মতো একটা উপন্যাস। 
আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের সাহিত্য অনেক অগ্রসর হয়েছে, অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। হয়তো অন্য কোনো সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না, আমরা তুলনা করতে যাবও না। কিন্তু অন্য যে কোনো সাহিত্যের সঙ্গে তুলনার অযোগ্য তা বলা যাবে না। এবং এর ইতিহাস কত দিনের, মাত্র তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের। তাতেও কিন্তু আমাদের সাহিত্য অনেক অগ্রসর_ তা বলতেই হবে। 
গত বিশ বছরে ঈদ সংখ্যার যে ক্রমবর্ধমান প্রচার-প্রচারণা তার উৎকর্ষের কথা বলতে গেলে আসলে ব্যবসাটা আগে চলে আসে। এখন ঈদ সংখ্যা উৎকর্ষের দিক থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। জনপ্রিয় লেখা বলতে যা বোঝায়, তা এখন পত্রিকাগুলো ছাপছে। আগে ঔপন্যাসিক একটা উপন্যাস লিখে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতেন, পেতেন দুইশ'-চারশ' বা পাঁচশ' টাকা। তাই ছিল তার প্রাপ্তি। এখন তো লাখখানেক টাকাও পান কেউ কেউ। ফলে এটাকে অন্যভাবে দেখলে চলবে না। এটা আমাদের দেশে এবং কলকাতা উভয় জায়গাতেই হচ্ছে।
উৎসবের সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্পর্ক সব দেশেই আছে। এসব উৎসব ঘিরে প্রকাশিত সাময়িকীগুলোতে জনপ্রিয় লেখার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ লেখাও প্রকাশিত হয়। আমার 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' ঈদ সংখ্যাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে 'দলিল' উপন্যাসটিও একটি দৈনিকের সাময়িকীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। 'প্রদোষে প্রাকৃতজন'-এর অষ্টম সংস্করণ চলছে, অন্যদিকে 'দলিল'-এর একাধিক সংস্করণ বেরিয়েছে। তবে জনপ্রিয় লেখার মতো এগুলো হই হই করে পাঠকরা কিনবে_ তা নয়। তবে এগুলোর একাধিক সংস্করণ তো প্রকাশিত হচ্ছে। আসলে ঈদ সংখ্যা ঘিরে সিরিয়াস লেখা এবং সঙ্গে সঙ্গে হালকা_ এ দু'ধরনের লেখাই বেরিয়ে আসছে। গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টা নির্ভর করছে আমাদের পাঠকদের মনোভাব, রুচির ওপর। 
আমাদের এখানে যে শিক্ষাব্যবস্থা, এই শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সাহিত্যপাঠ, সাহিত্যের যোগসূত্র কতটুকু_ তাও দেখতে হবে। বই যেগুলো পড়ানো হচ্ছে, তার সঙ্গে সাহিত্যের কতটুকু যোগসূত্র আছে, কী পড়ানো হচ্ছে, এগুলো দেখতে হবে। আসলে নোট পড়ে পাস করার রীতি আমাদের তৈরি হয়ে গেছে, এতে দিন দিন আমাদের ছেলেমেয়েদের সাহিত্যসহ স্কুলপাঠ্যবহির্ভূত বইপত্র পাঠের রুচি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পড়ার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। এটা আমাদের শিক্ষানীতি, সিলেবাস ইত্যাদি আধুনিকীকরণের নামে যা করা হয়েছে, তাতে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, এতে পাঠকের রুচির মধ্যে আগেই যে সাহিত্যপ্রীতি এবং মননশীলতা ছিল, তা নষ্ট হয়ে গেছে। তবে হতাশ নই। কেননা, মানুষ, দেশের জনগণই পথ দেখায়, তা সাহিত্যের ক্ষেত্রে হোক, শিল্পের হোক বা রাজনীতির ক্ষেত্রে হোক_ সর্বক্ষেত্রে। মানুষই পথ নির্মাণ করে।
 
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ : সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা এক শিল্পী
0%
 
গড় রেটিং:
 
রেটিং :
রফিকউল্লাহ খান
বাংলা সাহিত্যের পটভূমিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর পরিণতি অনেকটা মিখাইল বাখতিনের মতো। বিশ শতকের তিরিশের দশকে বাখতিন যখন তার তত্ত্ব প্রকাশ করেন, প্রায় তিন দশক পরে তার সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার বর্ণনামূলক সাহিত্য-ভাবনার ক্ষেত্রে এক বিপ্লবাত্মক রূপান্তরের তত্ত্ব-দর্শন হয়ে ওঠে। বাখতিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন পূর্ব ইউরোপের এক সংগ্রামশীল সমাজ পটভূমিতে, যেখানে যৌবনের উদ্দাম মুহূর্তগুলোতে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন রুশ বিপ্লবের রক্তাক্ত ও আলোকোজ্জ্বল ঘটনাপ্রবাহ। সঙ্গত কারণেই সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর পুঁজিবাদী বিশ্ব থেকে রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের অনেক নৃ-তাত্তি্বক ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে বাখতিনের সাহিত্য ভাবনা ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সম্পর্কেও পশ্চিমা বিশ্ব দীর্ঘকাল বঞ্চিত থাকে। বিশ শতকের তিরিশ, চলি্লশ ও পঞ্চাশের দশকের অনেক সৃষ্টিশীল সাহিত্য ও সাহিত্যতত্ত্বের ব্যাখ্যার সূত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শিল্প বিবেচনার মানদণ্ড হিসেবে বাখতিনের তত্ত্ব কতটা নিবিড় ও গভীরভাবে ছায়ার মতো প্রভাব বিস্তার করেছে ওইসব তত্ত্বের ওপর। বাখতিনের জন্ম ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে। মৃত্যু ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্যারিসে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক ঔপনিবেশিক সমাজ কাঠামোতে, যখন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সংগ্রাম রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে এক ইতিবাচক দিক লাভ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত যৌবনের উদ্দাম সময়গুলোতে তাকে দেখতে হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মন্বন্তর, মহামারী এবং ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের মতো একটি আরোপিত মধ্যযুগীয় বর্বর রাজনৈতিক সত্য প্রতিষ্ঠা। এবং তিনি দেখে যেতে পারেননি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
মিখাইল বাখতিনের অভিনবত্ব তার তত্ত্ব-দর্শন, সাহিত্যের অবয়ববাদী ব্যাখ্যা এবং উত্তর-আধুনিকতার আদি প্রবক্তাদের অন্যতম হিসেবে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে বাখতিন তার তত্ত্বের আবিশ্ব গ্রহণ ক্ষমতায় হয়তো কিছুটা অভিভূত হয়ে থাকবেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার জীবদ্দশায় কোনো দিক থেকে গভীরতর অর্থে ইতিবাচক মূল্যায়নের সৌভাগ্য লাভ করেননি। দুই-একজন সমালোচক তার উপন্যাস ও ছোটগল্পের বিষয় ও আঙ্গিকের অভিনবত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত করলেও শতধারায় বিভক্ত বাঙালি পাঠকের পক্ষে তার মূল্যায়ন অনেকটা দুরূহ ছিল। বিশ শতকের চলি্লশ ও পঞ্চাশের দশকে বাংলাভাষী ভূখণ্ডের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে যে বহুমুখী সংকট দেখা দেয় মানব অস্তিত্ব সন্ধানী যে কোনো সংবেদনশীল লেখকের জন্যই তা অত্যন্ত বেদনা-করুণ হয়ে উঠতে বাধ্য। উনিশশ' সাতচলি্লশের ভারত বিভাগ এবং বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের পাকিস্তান নামক নয়া ঔপনিবেশিক ও সামন্তবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তি বাঙালির সামগ্রিক সাহিত্যসাধনা ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এক অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বাঙালি জীবনের সেই চরম দুঃসময়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার ছোটগল্প, উপন্যাস ও নাটকগুলো রচনা করেন। সমকালীন সংকট চেতনাকে তিনি এতটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তার মর্মার্থ অনুধাবনের জন্য বাঙালি পাঠককে কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওয়ালীউল্লাহর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ 'নয়ন চারা' ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় এবং প্রথম উপন্যাস 'লাল সালু'র প্রকাশকাল ১৯৪৮ এবং প্রথম নাটক 'বহ্নিপীর'-এর রচনাকাল ১৯৫৫ ও প্রকাশকাল ১৯৬০। বিশ শতকের সাহিত্যের প্রধান তিনটি ধারায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর এই আত্মপ্রকাশ বাংলা সাহিত্যের বিষয় ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে নবধারার সৃষ্টি করে। আর্থ-উৎপাদন কাঠামো লালিত মানব অস্তিত্ব, তাদের সংগ্রাম এবং অভাবনীয় অথচ বাস্তবসম্মত রূপায়ণ তার এসব রচনাকে বিশিষ্ট করেছে। রোমান্টিসিজমের বহু বর্ণিল ও বাস্তাবাতিরেক শিল্পাদর্শকে তিনি যৌবনেই পরিত্যাগ করেছিলেন বাঙালির জীবনায়নের গভীর অভিজ্ঞতায়। জীবনকে তিনি পাঠ করেছেন বহুকৌণিক দৃষ্টি দিয়ে। অস্তিত্ব নিহিত সংগ্রাম, যন্ত্রণা ও রক্তক্ষরণের রেখা, রং ও টোনের সূত্র ধরে তিনি কেবল মানুষের কান্না দেখেননি কিংবা ব্যর্থতা রূপায়ণ করেননি, দেখেছেন জীবনের মর্মার্থ। বাইরের দিক থেকে জীবন একটি চলমান রেখামাত্র। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সংগ্রাম, মৃত্যু এগুলো হচ্ছে সেই জীবনরেখার অনিবার্য একেকটি অংশ। কিন্তু একজন অস্তিত্ববাদী, মানবীয় সম্ভাবনায় আস্থাশীল শিল্পীর পক্ষে জীবনের এ কাঠামো মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। জীবন তার কাছে কেবল বস্তু প্রত্যক্ষণ ও তার অবভাস মাত্র নয়। প্রতিটি ঘটনা ও পরিস্থিতির কার্যকারণ ব্যাখ্যা তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩) নিয়ে বেশকিছু গল্প রচনা করেন। তার মধ্যে অন্যতম 'নয়ন চারা' গল্পগ্রন্থের নামগল্প। এই গল্পে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা বাস্তব ঘটনাক্রম তার কাছে তাৎপর্য পায়নি, বরং দুর্ভিক্ষের প্রতিক্রিয়া সমগ্র মানবজীবন ও অস্তিত্বকে কতটা আলোড়িত, শিহরিত, বিপন্ন ও উদ্বেগাকুল করে তুলতে পারে, তারই একটি আখ্যান তুলে ধরেছেন অসাধারণ বর্ণনাভঙ্গির মধ্যদিয়ে। একটি সাহিত্য রূপ তখনই চিরকালের শিল্প হয়ে ওঠে, যখন সত্যস্পর্শী জীবন সত্য অনিবার্য তত্ত্বলগ্ন হয়ে প্রকাশ পায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রথম পর্যায়ের রচনায় যদি ভাবমুখ্য মানবধর্মকে (ঝঁনলবপঃরাব ঐঁসধহরংস) গ্রহণ করতেন, তীব্র, কঠোর, রূঢ় বাস্তবতাকে পরিহার করতেন অথবা দুইয়ের মধ্য একটি সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করতেন তাহলে তার কোনো রচনাই সমকালের এবং পরবর্তীকালের প্রাজ্ঞস্বর পাঠকের কাছে এতটা গ্রহণযোগ্যতা পেত না। তার 'মৃত্যুযাত্রা' (নয়ন চারা) গল্পটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও ক্রমাগত মৃত্যু অভিজ্ঞতা চারপাশের মানুষকে কতটা অস্তিত্বহীন, দিশাহীন ও অবসন্ন করে দেয় তারই একটি নির্মম চিত্র এই গল্পে প্রত্যক্ষ করা যায়। একটি জীবনের জন্য একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ও গোষ্ঠীগতভাবে মানুষ যখন দূরের ও নিকটজনের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে ক্রমাগত, তখন এক ধরনের অবশ নির্লিপ্তি জীবিত মানুষগুলোকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তাদের আচরণ ও উচ্চারণের মধ্যে ভয়ঙ্করভাবে অক্রিয় স্বভাব দেখা দেয়। মৃত্যু এবং ক্ষুধার পরস্পরবিন্যাস (ঔঁীঃধঢ়ড়ংবফ) কতটা মর্মভেদী হতে পারে তার একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে_
'_কী আবার হবি, মাথা হবি, মুণ্ডু হবি।' তিনু এবার গর্জে উঠল। এবং হয়তো তার সে জ্বলন্ত ক্রোধকে চাপা দেবার জন্যই করিম উঠে গিয়ে বুড়ির ছিন্ন ময়লা আঁচল দিয়ে তার বীভৎস মুখটা ঢাকা দিয়ে এলো। তারপর কে যেন রসিকতাও করল,
_ সবুর কর, বুড়োটা মরলে পরে দুটোকে এক সাথে গোর দেয়া যাবি_
গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে এখনো বুড়ো তেমনিভাবে চোখ বুজে নিশ্চল হয়ে রয়েছে।
ক্রমে ক্রমে একটি অধৈর্যের চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়তে লাগল সবার মধ্যে। একটিমাত্র মৃতদেহের জন্য তাদের এই আগ্রহাতিশয্যময় যাত্রা ঠেকে থাকছে, অথচ একদিকে শূন্য পেট করাত কাটা হচ্ছে। মন তাদের ছুটছে গঞ্জে-গঞ্জে, না দেখা শহরের আনাচে কানাচে, কল্পিত খাদ্যে রসালো হয়ে উঠেছে জিহ্বা। বেঁচে থেকেও ঝুনো বুড়ি তাদের পদে পদে জ্বালিয়েছে। মরেও যেন মুক্তি দিচ্ছে না।'
সংলাপের গভীর অর্থবহতার কথা বাখতিনের তত্ত্ব সূত্রে আমরা জানি। উদ্ধৃত অংশে দুটি সংলাপ মৃত্যু-বাস্তবতার এমন পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছে যা পরবর্তী বর্ণনাংশকেও কেমন যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং যে বৃদ্ধকে আমরা মৃত্যুমুখে দেখেছিলাম, তার মৃত্যু হতেও সময় লাগে না। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমাণ সেই ঘন অন্ধকার মৃত্যু শেষ পর্যন্ত নেমে আসে বৃদ্ধের জীবনে, যার চেয়ে মৃত্যুকে আরও গভীরভাবে দেখার কোনো পরিবেশ পরিস্থিতি, শব্দ ও ভাষার দৃষ্টান্ত আমাদের জানা নেই : যেমন_
'তারপর সন্ধ্যা হলো, হাওয়া থামল, ক্রমে ক্রমে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে উঠল এবং প্রান্তরের ধারে বৃহৎ বৃক্ষের তলে তার গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বুড়োর মৃতদেহ বসে রইলো অনন্ত তমিস্রার দার্শনিকের মতো।'
যেসব গল্পে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মানুষের বাস্তবজীবনের প্রচ্ছদ উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, সেখানে আবেগ, প্রেম, মোহ মানবসম্পর্কের সংবেদনশীল কোনো দিক গুরুত্ব পায়নি। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে শিল্পের অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করলে চিরকালের সাহিত্যই এই ধাঁচ বা চধৎধফরমস অবলম্বন করে। 'মতিন উদ্দিনের প্রেম' গল্পে নিম্নবিত্ত জীবনের অনেক অনুষঙ্গ আছে বটে। কিন্তু যে অর্থে সাহিত্যে প্রেম উপস্থাপন করা হয়, তার ক্ষীণতম অবভাসও সেখানে দেখা যায় না।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে আমরা প্রধানত তার ৩টি উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করি। তার জীবন গ্রহণ, জীবন রূপায়ণ বিষয় ও আঙ্গিকের অসাধারণত্ব আমরা স্বীকার করে নেই। তার ছোটগল্পের মধ্যে বিশ শতকের চলি্লশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাঙালি জীবনের এমন খণ্ড বিচূর্ণ, বিদীর্ণ ও বাস্তবাশ্রয়ী রূপ অঙ্কিত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর নৃ-তাত্তি্বক স্বাতন্ত্র্য, সম্প্রদায়গত অবস্থান, সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতা ও অস্তিত্ব সংগ্রামের যথার্থ চিত্র উন্মোচিত হয়েছে।

২.
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যে লেখকদের লেখক ছিলেন, তা পরবর্তীকালে অনেকেই স্বীকার করেছেন। কেউ সমালোচনার মাধ্যমে আবার কেউ কেউ তাদের রচনারীতির মধ্য দিয়ে। কয়েক দশক ধরে জাদুবাস্তবতার যে তত্ত্ব ও অনুশীলন লাতিন আমেরিকার অধ্যয়ন সূত্রে বহুল চর্চার উপজীব্য হয়ে উঠেছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনারীতি সেই নতুন ধারার গদ্যেরও পথপ্রদর্শক। একটি নতুন শিল্পকে দাঁড় করাতে গেলে একইসঙ্গে বিষয়বস্তু রচনারীতি ও ভাষাভঙ্গি সৃষ্টি করতে হয়। এক্ষেত্রে রচনারীতি হচ্ছে আধুনিক সাহিত্যের জন্য সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের লেখকরা বিষয় উপস্থাপনের জন্য নতুন নতুন ভাষারীতি সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে ওঠেন। সেসব লেখকের মধ্যবিত্ত জীবনকেন্দ্রিক রচনা রবীন্দ্রনাথের শব্দসম্ভার অতিক্রম করতে সমর্থ হয়নি। যারা নিম্নবর্গ ও প্রান্তিক জীবনের প্রভিজ্ঞতাকে কথাশিল্পে অকপট রূপ দিয়েছেন, তাদের মধ্যেই এই নতুন ভাষারীতির প্রকাশ আমরা লক্ষ্য করি। এক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। এই দু'জন লেখকের মধ্যে রাজনৈতিক দর্শনের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এবং সেই দর্শনশিল্পীর নির্লিপ্ততা কতটা বিক্ষিপ্ত করতে পারে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষদিকের রচনা এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন পর্যায়ের রচনা তার দৃষ্টান্ত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কোন রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট নয়। মনুষ্যত্ব কিংবা মানব ধর্ম কিংবা মানবতা_ এ শব্দগুলো তার তত্ত্বচিন্তা বা সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী দর্শন তার জীবন-জিজ্ঞাসাকে প্রভাবিত করেছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। চলি্লশ-পঞ্চাশের দশকের ফরাসি এবং স্পেনের 'নব্য উপন্যাস' আন্দোলনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকেও তিনি কাছে থেকে দেখেছিলেন। অবয়ববাদ ও উত্তর-অবয়ববাদকে তিনি দেখেছিলেন ক্রমঅগ্রগতির চঞ্চল ধাবমানবতায়। তার নিজ সমাজ ও আর্থ উৎপাদন কাঠামোমুখী শিল্পীমন একটি জীবনকেই সমগ্র অবয়বে প্রত্যক্ষ করেছে এবং সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিকে রূপদান করেছেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে যে মূল্যায়ন সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, তা হলো তিনি বাংলাদেশের লেখক। বাংলাভাষার হাজার বছরের ধারাক্রমে বিশ শতকের চলি্লশের দশকের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহই প্রথম বাংলা কথাসাহিত্যের উপকরণ, বিষয় ও শিল্পরীতির চারিত্র কী হতে পারে তার স্বরূপ নির্দেশ করেন। আধুনিক বাংলা উপন্যাসের জীবন রূপায়ণের ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল থেকেই একটা অপূর্ণতা ছিল, তা হচ্ছে মুসলিম জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বসত্তার রূপায়ণ। বাঙালি মুসলমানের জীবন নিয়ে দেশ বিভাগের আগেও অনেক উপন্যাস রচিত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বমানের জীবন-জিজ্ঞাসা ও শিল্পরূপ সেগুলোতে অনুপস্থিত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহই প্রথম নির্দেশ করেন বাংলাদেশের উপন্যাসের ধারা, বাংলাদেশের উপন্যাসের সংলাপের ধরন কী এবং মধ্যবিত্তের অবচেতনকে কোন অনিবার্য শব্দ শৃঙ্খলায় উপস্থাপন করতে হবে, তার স্বভাবধর্ম। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'লাল সালু' (১৯৪৭), 'চাঁদের অমাবস্যা' (১৯৬৪) এবং 'কাঁদো নদী কাঁদো' (১৯৬৮) ক্রমগ্রসরতার বিষয়বস্তু ও শিল্পরূপের সাম্যবাহী। অন্যদিকে তেমনি তিন দশকের বাঙালি জীবনের অন্তর ও বহির্বাস্তবতার রূপায়ণ, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তবতার একটা দৃশ্যমান চরিত্র বিদ্যমান থাকে আর আমরা সাধারণত সেই বাস্তবকেই সহনীয় ও গ্রহণযোগ্য মনে করি। মৃত্যু, বিনয়ী আত্মবিশ্বাস, আত্মবিচ্যুতি এ বিষয়গুলোকে বর্ণনাত্মক শিল্পে উপস্থাপন করলেও অনিবার্য চরিত্র ও ভাষারীতির অভাবে তার গ্রহণযোগ্যতা অল্পকালের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। উপন্যাসে একটি কালকে ধারণ করাই হলো তার সমাজ বাস্তবতা, চরিত্র বাস্তবতা এবং ভাষা ও সংলাপগত যথার্থতা সৃষ্টি করা। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালের খুব কম লেখকের মধ্যে এই ত্রিবিধ বৈশিষ্ট্য শিল্পসম্মতভাবে রূপ লাভ করেছে। একটি চরিত্রের বহির্বাস্তবতা এবং অন্তর্জীবন যেমন অভিন্ন নয়, তেমনি তার সরলরৈখিক বহির্বাস্তবতা প্রকাশের ভাষারীতি এবং বহুরৈখিক, দ্বন্দ্বময় ও জটিল অন্তর্জীবন উন্মোচনের ভাষাও অভিন্ন হতে পারে না। ভাষা ব্যবহারে এই মহাজ্ঞান বা সত্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার গল্প, উপন্যাস ও নাটকে প্রয়োগ করেছেন। অজস্র বাঙালি লেখকের তুলনায় তার রচনা সংখ্যাবিচারে অত্যন্ত কম। তিনটি উপন্যাস, চারটি নাটক, দুটি গল্পগ্রন্থ ও প্রায় অর্ধশত গল্প নিয়ে তার সাহিত্যভুবন গড়ে উঠেছে। কিন্তু তত্ত্ব, উপকরণ, বিষয় ও আঙ্গিক বিচারে তার স্বল্পসংখ্যক রচনাই বাঙালি সাহিত্য সমালোচনার বাঁক পরিবর্তনের দিকনির্দেশক হয়ে উঠেছে। কেবল সাহিত্যের তত্ত্ব ব্যাখ্যা ও সমালোচনাই নয়, অনেক সৃষ্টিশীল লেখকও তাদের বর্ণনাভঙ্গিকে ওয়ালীউল্লাহর ছাঁচে ফেলে বিষয় ও আঙ্গিকের নিত্যনতুন পরীক্ষায় আত্মনিয়োগ করছেন। চেতন-অবচেতনের ভাষা দ্বৈরথ কীভাবে প্রান্তিক জীবন থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের জীবন রূপায়ণের মাধ্যম হতে পারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার উপন্যাস ও ছোটগল্পে অত্যন্ত নিপুণভাবে তা দেখিয়েছিলেন। বাংলাভাষায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মূল্যায়নে যে ধরনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দর্শনজ্ঞান ও যুদ্ধ-উত্তর সাহিত্য ভাবনার অঙ্গীকার প্রয়োজন, তার পথ সন্ধানই এ অসাধারণ প্রতিভার ঋণ স্বীকারের একমাত্র পথ।
 
দিনের পর দিন
0%
 
গড় রেটিং:
 
রেটিং :
দিলওয়ার

যাচ্ছে এমন এক সময়

_ উদাহরণ দাও।

দৈনিকে চোখ বুলাও,

সংবাদ-এর শিরোনামগুলি
পাঠ করো
মনের গভীরে রেখে মুক্তিযুদ্ধের ন'মাস 
তখন_

_ তখন কী?

_ তখন তোমার চোখে ভেসে উঠবে
একটি ঢাউস বাংলা অভিধান
শত বছরের পুরনো_ 'শব্দকল্পদ্রুম'।

_ কী বলে দ্রুম?

_ প্রবাদ প্রবচনের অধ্যায়ে বলে_
হুজ্জতে বাঙ্গাল হেকমতে চীন!

২.
সাম্প্রতিক কিছু সংবাদ শিরোনাম
'তিনদিনে ১২০ কোটি টাকা লুটপাটের 
তদন্ত হচ্ছে।' _সমকাল
'ওবামাকে দৈনিক ৩০ বার হত্যার হুমকি।'
_সমকাল
'পররাষ্ট্র কর্মকর্তাদের একি কাণ্ড!' _সমকাল।
'লাগামছাড়া আকাশ সংস্কৃতি।' _সমকাল!
'রাসিকের কোটি কোটি টাকার জায়গা
এখনও বিএনপি নেতাদের দখলে!' _সমকাল।

'কুষ্টিয়ায় অবৈধ নছিমন, করিমনের
১০ কারখানা'। _সমকাল!

'এমপিওভুক্তির জন্য
১৭ বছরে ৮৬ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন।'
_ সমকাল।
'পাবনার মানসিক হাসপাতাল এখন
রুচিহীনদের বিনোদন কেন্দ্র!' _সমকাল।

৩. 
মুক্তিযুদ্ধের ন'মাস বাড়িতে নেই,
কেউ বলে_ ওরা গেছে মেরু পর্যটনে
ওখানে তারা তালাশ করবে
তাদের পূর্বপূরুষ 'ইয়েতি'-কে!

কবে ফিরবে? কী আশ্চর্য!

খোদ উত্তর সোনার হরিণ হয়ে যায়,
চিড়ে চ্যাপ্টা জনগণ স্বপ্নে দেখে
মৃগের গর্ভকোষে ন'মাসের একটি শাবক!
 
বর্ষার কবিতা
0%
 
গড় রেটিং:
 
রেটিং :
গোলাম কিবরিয়া পিনু

ধারাপতন

কূলসনি্নহিত মানুষ আমিও
প্লাবনের জল এলে 
জোয়ারের জল এলে
আমি কি তখন স্থির থাকতে পারি?
এবার বারিবর্ষণ বেশি
হয়ে যাই এলোকেশী!
ধারাপতন কি আর এক পতন আনবে টেনে?

বরিষণ মুখরিত পবনহিল্লোল

ধূলিধূসর অবস্থা নিয়ে থাকতে থাকতে
অনার্দ্র হয়েছি অনার্য যুবক
ভুলে গেছি রাঙামাটি,
যেখানে আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস ছিল
বাদলবর্ষণ ছিল_
ঊর্ণামেঘ ঢেকে দিত আকাশের নীল!
সেইখানে মজানদী হাহাকার করে_
মেঘ দেখলে আমি কেন
অন্যরাও খামছে ধরে!
বরিষণ মুখরিত পবনহিল্লোল আজ
সাজ পরে আসুক_ ভাসুক ধুলোপড়া পথঘাট
ভিজে যাক আমারও বালুভরা মাঠ!
 
চোখ
0%
 
গড় রেটিং:
 
রেটিং :
শাহীন রেজা

চোখের দিকে তাকা, ও চোখ
আলোর বৃন্ত ঘেঁষে এঁকে রাখ শোক।

চোখের দিকে তাকাতে তাকাতে চোখ বাঁধা পড়ে
নদীর দিকে তাকাতে তাকাতে মৎস্যপ্রেম
আলোর দিকে চক্ষু রেখে রেখে অগি্নগ্রহণ
শুধু অন্ধকারের ভয়ে চোখ নিমীলিত।

চোখের দিকে তাকা, ও চোখ
স্বপ্নভঙ্গ রাতে রমণীরা শুধু মৃতলোক।
 
আবাস
0%
 
গড় রেটিং:
 
রেটিং :
বুলবন ওসমান
পড়ন্ত বিকেল। পেছন থেকে দেখলেও বিরাট ভবনটির অস্তিত্ব জানান দেয়, এটি খ্রিস্টীয় উপাসনালয়। রাজশাহীর বাইপাস সড়কে দাঁড়িয়ে রিকশা থেকে নেমে সুহাস আলোকমাখা ভবনটি দেখতে থাকে। কয়েক মিনিট পর রিকশায় ওঠে। এবার এর পাশ দিয়ে গড়ানে যাওয়া রাস্তায় রিকশার গতি বেশ দ্রুত। যতটা কাছে ভেবেছিল ততটা কাছে নয়। অনেকটা রাস্তা অতিক্রম করে বাঁয়ে রিকশা টার্ন নেয়। ডিংগাডোবা এই অঞ্চলটা তেমন সমৃদ্ধ নয়। ধনী-গরিব মেশানো জনবসতি। রাস্তার অবস্থা অতি দরিদ্র। একটা রিকশা চালার মতো বাঁধান অবস্থান নেই। ঝাঁকানিটা বেশ কষ্ট দেয়। কিন্তু সামনে দর্শনীয় বস্তু থাকলে অমন কষ্ট সহ্য করা যায়। আরও বেশকিছুটা ধানি জমি ও বসতি পার হয়ে রিকশা উত্তরে এগিয়ে চলে। এবার বাঁয়ের রাস্তা ধরতে হবে। দূর থেকে ভবনটি গোচর হয়। এখানে রাস্তাটি কংক্রিট বাঁধান। দু'পাশে একতলা সব ছোট ছোট চালাবাড়ি। উঠোনে ছেলেমেয়েদের খেলতে দেখল, পুরো বসতিটা সাঁওতালদের। এদের পোশাক-আশাক বেশ পরিচ্ছন্ন। হেসে হেসে কিশোরীরা বৈকালিক খুনসুটিতে মত্ত। ছোটরা ছোট বল নিয়ে খেলছে। একটা ছোটখাটো কলোনির মতো। কলোনি পার হয়ে রিকশা শেষ মাথায় থেমে গেল। এবার প্রার্থনালয়ের এলাকা শুরু। রিকশা বিদায় করে দেয় সুহাস। বেশ বড় এলাকা নিয়ে এই প্রার্থনালয়। পাশের একটা তিনতলা ভবনের বারান্দায় এক যুবককে দেখে সুহাস এগিয়ে যায়। জানতে চায় অদূরে অবস্থিত গির্জার নাম।
এর নাম উত্তম মেষপালক ক্যাথিড্রাল। এই ভবনটি কী? তিনতলা ভবনটির কথা জিজ্ঞেস করে সুহাস।
এটা স্কুল।
তুমি ক্রিশ্চান?
হ্যাঁ।
কী কর?
এসএসসি পাস করেছি। এখনও কিছু করি না। তবে কাজ একটা পেয়ে যাব।
এটা ক্যাথলিক, না প্রোটেস্ট্যান্ট মিশন?
এটা ক্যাথলিক মিশন।
ভেতরে কেউ কি আছেন?
আছেন। ফাদার রাফায়েল। আপনি ভেতরে যান, দেখা পেয়ে যাবেন।
সুহাস ছেলেটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে চলে। নতুন মাটি ফেলা হয়েছে। মনে হয় ভিটেবালি। পায়ে পায়ে উড়ছে, এখনও ভালো করে বসেনি। পুরো চৌহদ্দি উঁচু পাঁচিল ঘেরা।
উত্তম মেষপালক ক্যাথিড্রালটির সামনে দাঁড়িয়ে সুহাস ভালো করে দেখতে থাকে। বাংলাদেশে এমন চমৎকার ক্যাথিড্রাল আর একটা দেখেনি। সদ্য সমাপ্ত মনে হচ্ছে। ক্যাথিড্রালসংলগ্ন দোতলা ভবনটিতে মনে হয় যাজকদের বসবাস। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তবে ছেলেটি যখন বলেছে, নিশ্চয় ভিতরে কেউ আছে। বিশেষ করে ফাদার রাফায়েল নামক যাজকের নাম সে উল্লেখ করেছে।
সামনে দাঁড়িয়ে ভালো করে চারপাশটা দেখে সে ডানে ঘোরে। এগিয়ে গিয়ে বাঁয়ে চোখ পড়তেই দেখে সাদা রোব পরিহিত এক ফাদার। নিশ্চয় ইনিই ফাদার রাফায়েল। সুহাস এগিয়ে গিয়ে দেখে ফাদার একটি চারাগাছে জল দিচ্ছেন।
সুহাস গলা খাঁকারি দেয়।
ফাদার ঘুরে দাঁড়াতেই সুহাস বলে, গুড আফটার নুন ফাদার?
শুভ বিকেল, প্রত্যুত্তর ফাদারের।
আপনি? ফাদার প্রশ্ন করে।
ফাদার, আমি ঢাকা থেকে এসেছি। 
রাজশাহী অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য মন্দির-মসজিদ, গির্জা নিয়ে একটা স্টাডি করছি। ক্যাথিড্রালটি মনে হয় নতুন হয়েছে?
হ্যাঁ। এটি দু'হাজার তিন সালে সমাপ্ত হলো। বেশ শুদ্ধ বাংলায় ফাদার জবাব দেন।
ফাদার, আপনার দেশ?
ইতালি আমার দেশ। এই ক্যাথিড্রাল সরাসরি ভ্যাটিকানের সাহায্যে নির্মিত।
ফাদার আরও দু'একটি ফুলগাছে হাতের জগে থাকা জল সমাপ্ত করে বলেন, চলুন, আমরা ভেতরে গিয়ে বসি।
চলুন।
সুহাস ফাদারকে অনুসরণ করে।
ক্যাথিড্রালের পাশে বসবাস ও পরিচালনা দফতর অবস্থিত। নিচের একটি কামরায় ফাদার প্রবেশ করেন। ছোট কামরা। একটা টেবিল। ওপাশে জানালা, দরজামুখী একটি চেয়ার রাখা। ফাদার ওটায় উপবেশন করেন। এদিকে দুটি চেয়ার। হাতলহীন।
সুহাসকে বসতে বলে ফাদার।
ফাদার, আপনার নাম রাফায়েল?
হ্যাঁ, কী করে জানলেন?
সামনে একটি যুবক আপনার কথা বলল।
ফাদার, আপনাদের নামের শেষে পিসে লেখা থাকে, এর অর্থ কী?
এটা হলো পনটিফিক্যাল ইনস্টিটিউট ফর ফরেন মিশন থেকে যারা শিক্ষা গ্রহণ করে তাদের জন্য প্রযোজ্য। আমাদের এ ব্যাপারে প্রচুর শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়।
এই মিশনে আপনারা ইতালিয়ান ক'জন আছেন?
আমরা আছি দু'জন। আর একজন বাঙালি ফাদার আছেন।
আচ্ছা ফাদার, সাধারণ গির্জা আর ক্যাথিড্রালের মধ্যে পার্থক্য কী?
আপনি জানেন যে, লাতিন ও গ্রিক ভাষায় ক্যাথেড্রা বলে একটি শব্দ আছে_ যার অর্থ একটি আসন বা এ সিট। ক্যাথিড্রালে বিশপের একটি আসন থাকে। যা সাধারণ গির্জায় থাকে না। আমাদের যাজকদের যে হায়ারার্কি আছে তাতে বিশপের আসন অনেক উঁচুতে।
আপনাদের স্কুলটা কোন শ্রেণী পর্যন্ত?
এটা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। আমরা এই বাগানপাড়া বিদ্যালয়কে দশম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার ইচ্ছা পোষণ করি। শুধু আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি পৃথক কলেজও দরকার। তবে এখানে আদিবাসীদের সঙ্গে বাঙালি ছাত্র পড়তে পারবে। আমরা চাই আদিবাসীরা যেন পৃথক হয়ে না থাকে। তারা যেন বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে মিলেমিশে জীবন অতিবাহিত করে। নিজেদের আলাদা করে রাখলে সামাজিক সমস্যা বৃদ্ধি পায়। কলেজ করার একটি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি হবে বনপাড়ায়।
বনপাড়া জায়গাটা শুনেই চিনতে পারে সুহাস। হাটিকুমরুল থেকে বনপাড়া সরাসরি নতুন সড়ক হয়েছে। এতে রাজশাহী পেঁৗছতে সিংড়া অঞ্চল অতিক্রম করতে হয় না। প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরত্ব কমে গেছে।
বাগানপাড়া ছাড়া আপনাদের মিশনের আর কোথাও কি জায়গা আছে?
হ্যাঁ। আমাদের আরও স্থান আছে_ আলীগঞ্জ, মহিষবাথান ও পূর্ব কোটালীপাড়ায়। এসব জায়গায় আদিবাসী সাঁওতালরা থাকে। আর জায়গা আছে আঁধার কোটায়।
এই সময় ফাদার উঠে দাঁড়ায়। কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলেন, আপনি বসুন, আমি এখনি আসছি।
সুহাস একা একা বসে ভাবতে থাকে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এসব মহৎপ্রাণ মানুষরা দরিদ্রের সেবায় নিজ দেশ ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে থাকেন, আর আমরা? পরস্পর হানাহানিতে ব্যস্ত। এদেশে দরিদ্রের সেবায় আমরা কত বিমুখ। শুধু আত্মসেবা। নিজ পরিবারের জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। প্রতিযোগিতা। অথচ আমরাই ধর্ম-কর্মের নামে কী গদগদ। দিকে দিকে মসজিদ-মাদ্রাসা। সুহাসের ভাবনায় ছেদ পড়ে। দু'হাতে দু'কাপ চা হাতে ফাদারের প্রবেশ।
একি ফাদার! আমাকে সঙ্গে নিতেন! আমি আপনাকে সাহায্য করতাম।
আপনি অতিথি! তাছাড়া গরম জল তৈরি ছিল, শুধু চা-পাতা আর চিনি নেড়ে নেওয়া।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে সুহাস ফাদারকে ভালো করে দেখে। প্রশস্ত মুখাবয়ব। গোলাপি চিক। মাথাভরা টাক। কিন্তু চোখ দুটো কী সজীব।
ফাদার, বাংলাদেশে কত বছর হলো?
সেই উনিশশ' বাহাত্তর সালে এসেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। দেখুন না, দেখতে দেখতে পঁয়ত্রিশ বছর হয়ে গেল।
বাড়ি যান না?
যাই। এই তো, তিনদিন পর তিন মাসের জন্য দেশে যাব।
বাহ, আমার ভাগ্য ভালো। তিনদিন পর এলে আপনার দেখা পেতাম না।
আপনি তিন মাস পর আসুন, আবার দেখা হবে। আপনারা যারা শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন তাদের আমার খুব শ্রদ্ধা হয়।
আপনারা আরও বড় শ্রদ্ধার পাত্র ফাদার।
না, না, কী যে বলেন। আমরা দুঃখী মানুষের সেবা করি, যিশুর প্রবর্তিত পথ অনুসরণ করে। এটা আমাদের কর্তব্য মাত্র।
শুধুই কি কর্তব্য?
দেখুন, মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে এটাই তো স্বাভাবিক।
এই স্বাভাবিক গুণটাই তো এ দেশে বিরল। একদল সম্পদের পাহাড় গড়ছে, আর একদল নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
হ্যাঁ, বর্তমানে এমনটা চলছে বটে, তবে আপনারা অচিরে এটা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। আপনাদের সাধারণ মানুষ খুবই ভালো।
এটা ঠিক বলেছেন ফাদার। আমরা শিক্ষিত সম্প্রদায় ওদের মতো সহজ সরল হতে পারিনি। আমাদের চাহিদা অনেক বেশি।
দেখুন, লোভ যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় সব নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়।
পশ্চিমে সূর্য ক্যাথিড্রালের দেয়ালে আড়াল। হঠাৎ কক্ষটায় আলো বেশ কমে এলো। সুহাস সচেতন। ফাদারকে ছেড়ে দেওয়া উচিত।
উঠে দাঁড়ায় সে।
ফাদারও উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি না থাকলেও রোববার সকালে প্রার্থনায় আসবেন। দেখবেন বাঙালি ও আদিবাসীরা মিলে প্রার্থনা সঙ্গীত পরিবেশন করছে। আপনার ভালো লাগবে।
আসব।
সুহাস ফাদারের সঙ্গে কামরা থেকে নির্গত হয়। বাইরে ছায়াঢাকা অঙ্গন। মায়ামাখা। মনটা কেমন পবিত্র হয়ে ওঠে। ফাদারকে বিদায় জানিয়ে সে স্থান ত্যাগ করে।
নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ করতে করতে রাজশাহীতে সুহাসের প্রায় কুড়ি দিন কেটে গেল। এবার রাজধানী ফেরার পালা। ফেরার আগের দিন আবার বিকেল বেলা পেঁৗছায় উত্তম মেষপালক ক্যাথিড্রালে। আজও প্রাঙ্গণে কাউকে দেখল না। প্রথম দিনের মতো আবার ক্যাথিড্রালের উত্তর দিকের বাগানে গিয়ে সুহাস অবাক। প্রথম দিন যেমন ফাদার রাফায়েলকে জগ হাতে গাছে জল দিতে দেখেছিল, তেমনি আজও জল দিচ্ছেন।
হাই ফাদার, ফাদার রাফায়েল ঘুরে দাঁড়াতেই সুহাস বলে, আপনার কি দেশে যাওয়া হয়নি?
না গিয়েছিলাম। তবে ভালো লাগল না। পনের দিন থেকেই চলে এসেছি।
মাত্র পনের দিন!
অবাক হওয়ার পালা সুহাসের। হাতের জলটুকু একটি গাছে ঢেলে দিয়ে ফাদার বললে_ চলুন, আপনাকে বলছি।
দু'জন পূর্বের কামরায় আসন গ্রহণ করে।
দেখুন, দেশে গিয়ে দেখি মানুষ শুধু ছুটছে, ছুটছে আর ছুটছে। কী জন্য যে ছুটছে আল্লাই জানে।
ফাদার রাফায়েল 'আল্লাই জানে' কথাটা এমনভাবে বললেন, যেন তিনি একজন বাঙালি মুসলমান। গলার টোনটা এত স্বাভাবিক যে, কোনো মতেই মনে হলো না তিনি একজন ইতালির অধিবাসী।
দেখুন, বাংলাদেশে ইচ্ছা করলেই আপনি একজন দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করতে পারেন, কিন্তু ইতালিতে আপনি তা পারবেন না। কাউকে সাহায্য করতে চাইলে আপনাকে কোনো সংস্থার কাছে যেতে হবে। তারা সাহায্য করবে। আপনি নিজে থেকে সরাসরি কিছু করতে পারবেন না।
সবই কি মাফিয়া পরিচালিত?
সে আপনি যাই বলুন। খানিক চুপ থেকে বললেন, আমাদের মিশনে আর ইতালির কোনো ফাদার আসবেন না। আমরা যারা আছি আমরাই শেষ বিদেশি। এখন থেকে আঞ্চলিক ফাদার বা বিশেষজ্ঞরা মিশন পরিচালনা করবেন।
আপনার কী ইচ্ছা, শেষ পর্যন্ত থাকবেন, না দেশে চলে যাবেন?
ফাদার সুহাসের মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন।
তারপর বলেন_ চলুন, আপনাকে নিয়ে একটা জায়গা ঘুরে আসি।
দরজায় তালা মেরে দু'জন বেরিয়ে পড়ে। সাঁওতালদের কলোনি ফেলে বড় রাস্তা ক্রস করে সোজা পূর্বদিকে এগিয়ে চলে। এই রাস্তাটা বেশ শীর্ণ। ডানদিকে নতুন সব বাড়ি তৈরি হচ্ছে। বোঝা যায় শহর এদিকে ঢুঁ মারছে।
বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বাঁয়ে একটা বড় পাঁচিল ঘেরা জায়গার ফটক দিয়ে দু'জন প্রবেশ করে।
এটি আমাদের মিশনের গ্রেভইয়ার্ড, বলেন ফাদার।
সামনে বড় একটা জায়গায় রজনীগন্ধার চাষ হয়েছে। অনেক ফুলের ডাঁটা খাড়া, আকাশমুখী। একটা চমৎকার ঘ্রাণ আসে। প্রায় বিঘা দুই জায়গা হবে। উঁচু পাঁচিল। ওপাশে একটা নালা। তারপর ধানক্ষেত। দেয়াল ঘেঁষে লাগানো হয়েছে অনেক মেহগিনি, সামাজিক বনায়নের চেহারা নিয়েছে। মাঝখানে গিয়ে ফাদার বাঁয়ে বাঁক নেন। একটা চমৎকার করে বাঁধান কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ান।
এটা আমার আগে যে ফাদার এসেছিলেন তার কবর। সম্প্রতি মারা গেছেন।
তিনি কি ইতালিয়ান ছিলেন?
হ্যাঁ।
এই কবরের পেছনে অনেক কবর। সার দিয়ে কবরস্থ করা। অন্যান্য কবরের তুলনায় এটি বেশ বড় ও সুশোভিত।
গাছের আড়ালে সূর্য পাটে। কবরস্থানটায় আধো আলোছায়া খেলা করছে। অনেক পাখি নীড়ে ফিরে এসেছে। তাদের কাকলি নীরবতা ভঙ্গ করে চলে।
আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন না শেষ পর্যন্ত এখানে থাকব কি-না?
একটু থেমে বলেন, দেখেছেন তো এই কবরটার পাশে আর একজনকে কবর দেওয়ার জায়গা আছে?
হ্যাঁ, আর একজনকে কবর দেওয়া যাবে, বলে সুহাস।
আমি মিশনের সবাইকে বলে রেখেছি আমি না মরা পর্যন্ত জায়গাটা যেন খালি রেখে দেওয়া হয়।
সুহাস ফাদারের মুখের দিকে দৃষ্টি ফেলে। ফাদারের মুখে বয়সের বলিরেখাগুলো স্পষ্ট। শুধু চিকচিক করছে মায়ামাখা একজোড়া চোখ।
 
মোটরসাইকেল ডায়েরি : উত্তমপুরুষের উপন্যাস
0%
 
গড় রেটিং:
 
রেটিং :
সৌমিত চন্দ্র জয়দ্বীপ
'বিপ্লবের বরপুত্র', 'বিপ্লবের প্রতিমূর্তি' কিংবা 'বিপ্লবের প্রাণপুরুষ'_ বিনাবাক্য ব্যয়ে বিশ্বব্যাপী তার অবিসংবাদিত পরিচয় এটিই। নিদ্বর্িধায়-নিশ্চিন্তে বলা যায়, বিশ্বের লাখ লাখ বিপ্লবীর মিছিলে 'অগি্নবিপ্লবী' চে মিশে থাকেন প্রেরণাদাতা হিসেবে। কিন্তু একজন মহানায়ক, তার পদচারণা কি শুধুই একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে? তাই হয়তো চে গুয়েভারার ছবি কোথাও শোভা পেলে গোচরে কিংবা অগোচরে ভেসে ওঠে_ ডাক্তার, মার্কসিস্ট, দার্শনিক, ইকনোমিস্ট, গেরিলা, লিডার, রেভুলুশনারি, হিরো, আইকন প্রভৃতি শব্দসম্ভার। বহু গুণে গুণান্বিত চে গুয়েভারা একজন মার্কসবাদী দার্শনিক হিসেবে যা চিন্তা করতেন কিংবা বলার চেষ্টা করতেন তার প্রধানতম প্রামাণ্য দলিল অবশ্যই তার বিপ্লবীসত্তা। তবে বিপ্লবপ্রাণ চে'র চিন্তা-চেতনার পূর্ণ প্রকাশ তার অসংখ্য লেখালেখির মধ্যে সগর্বে বর্ণিত হয়েছে। কিংবদন্তি চে গুয়েভারা তার ৩৯ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে, যে জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে বিপ্লব ও ভ্রমণে, শুধু কিউবান ভাষাতেই লিখেছেন প্রায় ৭০টি নিবন্ধ, ছদ্মনামে কিংবা নামহীন অবস্থায় ২৫টি। লিখে দিয়েছিলেন পাঁচটি বইয়ের ভূমিকাও। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ভাষণ আর সাক্ষাৎকার দেওয়ার পরিমাণও প্রায় আড়াইশ'র মতো। বিভিন্নজনকে লেখা তার অসংখ্য চিঠির মধ্যে সংগ্রহ করা গেছে মাত্র ৭০টির মতো। ভাবতেই অবাক লাগে, তার লেখালেখি নিয়ে এখন পর্যন্ত বের হয়েছে নয় খণ্ড রচনাবলি। আর এগুলোর মধ্যে অতিঅবশ্যই আলাদা মাহাত্ম্য বহন করে তার আজীবনের সঙ্গী, রোজনামচা লেখা। নিজের লেখা সেসব ডায়েরির পাতায় তিনি শুনিয়ে গেছেন অসংখ্য না জানা কাহিনী, না বলা গল্প।
'যে মানুষটি এই নোটগুলো নিয়েছিল সে তো আর্জেন্টিনায় ফেরার পথেই মারা গিয়েছিল। যে এর পরিমার্জনা করেছিল সে আমি তো আর আগের আমি ছিলাম না।... আমি সেই মানুষটির কাছে এখন আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি, যে মানুষ আমি আগে ছিলাম...।' সময়টা ১৯৫২ সাল। আর্জেন্টিনার রোজারিওর স্বাপি্নক সূর্যসন্তান চে তার স্বপ্নকে ধরার জন্য বেছে নিলেন বোহেমিয়ানের পথ। চে'র সঙ্গী হলেন বাল্যবন্ধু বায়োকেমিস্ট ডা. আলবার্তো গ্রানাদো। সম্পর্কে গ্রানাদো ছিলেন চে'র দুই সহপাঠী টমাস ও গ্রেগোরিওর বড় ভাই। চে ও গ্রানাদোর সঙ্গী হলো একটি পুরনো মোটরসাইকেল 'নরটন ৫০০', স্প্যানিশ ভাষায় 'লা পোদেরোসো টু'। পুরো লাতিন আমেরিকা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে নরটন নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন দুই বন্ধু। পুরো ভ্রমণে চে লিখে চললেন সেই ব্যস্ত সময়ের বিস্ময় জাগানিয়া কাহিনী। ঘটনার পর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গেছেন কাহিনীর নিয়ন্ত্রক, লেখক চে। সেটা কোনো রূপকল্পিত কাহিনী ছিল না, ছিল বাস্তবচিত্রের পরিপূর্ণ প্রতিফলন। নয় মাসের দক্ষিণ আমেরিকা পরিভ্রমণের সেসব রোমাঞ্চকর বাস্তববিধুর মুহূর্ত বিধৃত হয়েছে_ 'মোটরসাইকেল ডায়েরিতে। পরিচ্ছেদের প্রারম্ভিক উদ্ধৃতটুকু সেই বিখ্যাত গ্রন্থেরই অন্যতম চুম্বকাংশ। যে উদ্ধৃতি জানান দেয়, আজকের যে চে'কে নিয়ে আমাদের এত জিজ্ঞাসা, উচ্ছ্বাস-উল্লাস আদর্শিকতার মোহময় টান, তার দীপ্তিময় যাত্রা ও সত্তার বিকাশ কোথা থেকে। চে গুয়েভারা তার ডায়েরির পাতাগুলোকে অভিযাত্রা শেষ হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই গ্রন্থাকারে সাজিয়ে ফেলেছিলেন। পরে তিনি এটি আবার লেখেন। কিন্তু কিউবার রাজধানী হাভানায় চে'র ব্যক্তিগত আর্কাইভে থাকার পরও কোনো এক অনভিপ্রেত কারণে এটি আর প্রকাশের মুখ দেখেনি। তবে ধারণা করা যায় যে, তিনি আবেগতাড়িত হয়ে অথবা সচেতনভাবে অনেক অপ্রিয় সত্য কথা বলে ফেলেছিলেন। তাই হয়তো কিউবান কর্তৃপক্ষ বইটিকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখাই শ্রেয় মনে করেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই বই প্রথম প্রকাশিত হয় প্রায় ৪০ বছর পর ১৯৯৩ সালে। ইতালির মিলান থেকে। ১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত হয় এর ইংরেজি অনুবাদ। চে'র দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যালিদা মার্চ ডি লা তোরের সম্পাদনায় বইটি অনুবাদ করেন অ্যান রাইট। তারপর থেকেই বিশ্বব্যাপী এই বই নিয়ে তোলপাড়। আমেরিকান পরিচালক ওয়েস্টার সেলেস তো ২০০৪ সালে ওই নামে একটি চলচ্চিত্রই বানিয়ে ফেললেন।
চে গুয়েভারা মাত্র ২৩-২৪ বছর বয়সে এ গ্রন্থটি লিখেছিলেন। তাকে বুঝতে হলে তার এই ডায়েরির লেখাগুলোকে বিশ্বাস করা অত্যন্ত জরুরি। এমন কথা তিনি নিজেও তার গ্রন্থেই বলেছেন, 'পাঠক, কোনো মর্মস্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয়ে থাকলে আপনি তা এড়িয়ে যেতে পারেন। তবে আপনি যদি জানতে চান তাহলে যে দৃশ্য আমার ডায়েরিতে তুলে ধরেছি তা গ্রহণ করা ছাড়া আপনার উপায় নেই।' তাই একজন স্বল্পবয়সী তরুণের রোজনামচা হিসেবে গ্রন্থটিকে বিবেচনা করাটা সমীচীন হবে না। এ গ্রন্থের অবশ্যই একটি সাহিত্যমূল্য আছে এবং সেটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই গ্রন্থের অন্তত তিনটি পরিচ্ছেদ প্রথমত 'আসুন সোজাসুজি দেখি', প্রেমিকাকে নিয়ে লেখা 'রোমান্টিক স্মৃতি', মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহলোদ্দীপক ও রহস্যজনক 'একটি বিলম্বিত উপলব্ধি'-এর সাহিত্যিক মূল্য অনেক অনেক বেশি। তাদের পুরো যাত্রার পরতে পরতে রয়েছে রহস্যের বেলাভূমি। কিন্তু এ তিনটি সম্পূর্ণ আলাদা। ঠিক বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে চে'র ওইসব বর্ণনায়। পুরো নয় মাস কী নিদারুণ কষ্টই না গেছে দুই বন্ধুর। এমনভাবে এগুলো বর্ণিত হয়েছে, যা সত্যি মর্মস্পর্শী। মাল বোঝাই পুরনো নরটনটাকেও তো আর কম কষ্ট পোহাতে হয়নি। পাথরের আঁকাবাঁকা রাস্তা, পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা কিংবা বালুবদ্ধ রাস্তায় নরটন নিয়ে তাদের যে অভিজ্ঞতা সেটার সরল বর্ণনা পীড়িত না করে পারেই না। এক সময় তো নরটনটাকে ছেড়েই যাত্রা চালিয়ে যেতে হলো। গ্রানাদোর সেই মুহূর্তের হতবিহ্বল অবস্থার কথা লিখতে গিয়ে চে'ও সম্ভবত আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন। পুরো অভিযাত্রাটাই ছিল যেন একটা থ্রিলার। অর্থ-বিত্তহীন দু'জন মানুষ বিদেশ-বিভূঁইয়ে যেভাবে সময়গুলো কাটিয়েছেন, উপবাস করেছেন অসংখ্যবার, নরটনহীন অবস্থায় অনেকবার, একবার ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটেছেন, চে নিজে যেভাবে আশৈশব হাঁপানির কষ্টে ভুগেছেন সবই পাঠক মনকে কৌতূহলী করে তোলে, করুণার জন্ম দেয়। উপন্যাস বাস্তব জীবনের কথা বলে। ফুটিয়ে তোলে মানব জীবনের স্পর্শী-অস্পর্শী, উত্থান-পতনের নানা দিক। 'মোটরসাইকেল ডায়েরি'ও তাই। কেবল ভ্রমণকাহিনী নয়, খোলা চোখে দেখলে এটি প্রকৃতপক্ষে একটি উপন্যাস। উত্তমপুরুষে লেখা এক উপন্যাস। লাতিন প্রোলেতারিয়ান সমাজের দুঃখ-দুর্দশার মর্মান্তিক চিত্র যে গ্রন্থকে মহিমান্বিত করেছে। পাঠক ধরে রাখার ক্ষমতা যার সহজাত, যার স্রষ্টা নিজেই অতি উত্তম এক পুরুষ, এই উপন্যাসের নায়ক, মার্কসবাদী নিয়মে যিনি নিজেকে একদিন শ্রেণীচ্যুত করে মিশে গিয়েছিলেন সানপাবলো কুষ্ঠাশ্রমের রোগীদের মতো অসংখ্য সাধারণ মানুষের কাতারে। 'একটি বিলম্বিত উপলব্ধি'তে শেষ করার আগে নাম-পরিচয়হীন যে ব্যক্তির উদ্ধৃতি চে দিয়েছেন সেই কথাগুলো কীভাবে তার পরবর্তী জীবনে এসে সত্য হয়ে গেল সেটাও রহস্য।
 
আত্মপরিচয়ের সন্ধানে বারাক ওবামা
0%
 
গড় রেটিং:
 
রেটিং :
রাহাদ আবির
একটি টেলিফোন কল। নাইরোবি থেকে। বেরির তখন সকালের নাস্তা আধাআধি হয়েছে। রুমমেটের ডাকে উঠে গিয়ে ফোনটা ধরল। ওপাশ থেকে তখন গড়গড় করে দ্রুত আওড়ে যাচ্ছে, হ্যালো বেরি বলছ? আমি তোমার আন্টি জেন। হ্যালো, শুনতে পাচ্ছ? শোন, তোমার বাবা গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। বেরি...
নভেম্বরের এক শীতের সকালে আচমকা এই ফোন পেলেন আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। যার পুরো নাম বারাক হুসেন ওবামা। সংক্ষেপে যাকে অনেকে বেরি ডাকত। যদিও বারাক তা পছন্দ করতেন না। শুধরে দিয়ে অনেককেই বলতেন, প্লিজ, কল মি বারাক। 
'ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার'। বারাক ওবামার ৪৪২ পৃষ্ঠার বইটির শুরুর অধ্যায়েই এই ফোন কলের কথা। এর পরপরই লেখক আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন তার বাবার গল্পে। অবশ্য তার কাছে বাবা মানে ধোঁয়াশা একটা ব্যাপার। তার যখন মাত্র দুই বছর বয়স, সেই ১৯৬৩ সালে, বাবা তাদের হাওয়াইতে রেখে হার্ভার্ডে ডক্টরেট করতে চলে যান। এরপর বাবার সঙ্গে ফের এবং শেষবার দেখা, তখন বারাক ১০ বছরের বালক। মাত্র দু'বারের দেখায় একটা মানুষের মনের মধ্যে বাবার চরিত্রটা কীরকম দাঁড়াতে পারে? মিথের কাল্পনিক চরিত্রের চেয়ে বেশি কিছু? বারাকও তার বাবাকে, যার নামও ছিল বারাক হুসেন ওবামা, এভাবেই কল্পনা করেছেন। 
বইটি পড়তে শুরু করলে ভোরের আকাশের ধীরে ফর্সা হওয়ার মতো একটি জিনিস পরিষ্কার হয়ে উঠবে। এটি একটি শেকড়সন্ধানী লেখা। বারাক ওবামা কালো মানুষ। তার বাবা এসেছিলেন আফ্রিকার দেশ কেনিয়া থেকে স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই ছিলেন প্রথম কোনো আফ্রিকান। আর মা অ্যান ডানহ্যাম, সাদা আমেরিকান, ক্যানসাসের বাসিন্দা। ল্যাংগুয়েজ ক্লাসে দুজনের প্রেম, পরিচয়। অতঃপর বিয়ে। সেটা ১৯৬০ সাল। যদিও বর্ণবিবাহ ছিল তখন অবৈধ। পরের বছরই মাত্র সতের বছরে অ্যান মা হলেন। আর বারাক হুসেন ওবামার পুত্র বারাক কালোই হলো।
কালোদের ওপর নিপীড়ন, বঞ্চনার শেষ নেই। এ নিয়ে আছে দীর্ঘ ইতিহাস। বারাক ছোট্ট বয়সেই বুঝে গেলেন কালো-সাদার বিভাজন। সাদারা কালোদের দেখতে পারে না, নিকৃষ্ট মনে করে। অথচ তার স্নেহময়ী মা সাদা। তবে সে এমন কালো কেন? তার বাবা কালো বলে?
যতই বয়স বাড়ে আমেরিকা নামক বিশাল দেশটিতে বারাক নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে ভোগেন। সাদাদের মাঝখানে তার মতো কালোকে বড় বেমানান লাগে। নিঃসঙ্গতায় ভোগেন তিনি। এছাড়া চলতে-ফিরতে, সবখানে কালোদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য তো আছেই। অথচ এই দেশ তার, এইখানে তার জন্ম। 
বইয়ের শুরুতে, সেই টেলিফোনের পর বারাক তার মা, নানা, নানির মুখে শোনা বাবার গল্প তুলে ধরেন। আসলে বাবা সম্পর্কে তার যতটুকু জানা তা এই গল্প শুনে শুনেই। দু'দুবার বারাক কেনিয়া যান। সে দুবার হচ্ছে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। কেন গেলেন তিনি কেনিয়া? এমন না যে বাবা ও বাবার পরিবারের সঙ্গে জোড়াতালি মারা কোনোরকম যোগাযোগ টিকে ছিল। বরং উল্টোটা। তার বাবা পাঁচ-পাঁচটি বিয়ে করেছিলেন। তার মধ্যে দুজন সাদা আমেরিকান। অবশ্য কেনিয়ার সমাজ-ব্যবস্থায় এরকম পাঁচ-ছয়টি বিয়ে এবং গণ্ডায় গণ্ডায় ছেলেমেয়ে হওয়াও স্বাভাবিক। তবে? ওই যে বললাম শেকড়, মূল যে তার সেই কেনিয়ায় বাঁধা!
প্রথমবার কেনিয়ার মাটিতে নেমে তিনি যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষে পরিণত হন। অনুভব করেন, এই তো তার আসল গোড়া। এখানের সব মানুষ তার মতো দেখতে। যেদিকে তাকাও কেবল কালো মানুষ। আমেরিকায় জন্ম হলেও এই প্রথম বারাক বিদেশের মাটিতে, তার পূর্বপুরুষের দেশকে অন্তর দিয়ে 'নিজের' বলে বোধ করেন। 
এই যে 'নিজের বোধ', আইডেনটিটি ক্রাইসিস বা আত্মপরিচয় সংকট, বর্তমান পৃথিবীতে এ সমস্যা কেবল একা বারাক ওবামার নয়। কালো, সাদা, বাদামি_ সব আদমিদেরই এ আত্মপরিচয়ের সংকট আছে। একটু ভালো খাওয়া, ভালো পরা, উন্নত জীবনের আশায় মানুষ ছুটছে দেশ থেকে দেশান্তরে। এ নতুন নয়। ইতিহাসের শুরু থেকেই এ দেশান্তর চলছে এবং চলবে। 
'ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার' বইটির তিনটি পার্ট বা অংশ_ অরিজিন, শিকাগো ও কেনিয়া। অরিজিন মানে উৎস, আর বারাকের উৎসটা কোথায়? সেই কেনিয়া। প্রথম ও শেষ_ দুটি অংশেই লেখক সেই উৎস বা আত্মপরিচয়ের সন্ধান করেছেন। মাঝের অংশ শিকাগো, যেই শহরে তার বেড়ে ওঠা, জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামী যৌবন। অরিজিন অংশের অনেকটা জুড়েই তার বছর পাঁচেক জাকার্তায় কাটানো সময়ের কথা আছে। তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন ইন্দোনেশিয়ান। তৃতীয় বিশ্বের নিদারুণ দারিদ্র্যের রূপটিও তিনি দেখেছেন সেখানে।
তিনটি অংশের মধ্যে কেনিয়ার অংশটিই বেশি আকর্ষণীয়। লেখকের যেমন সেটা ভালো লাগার জায়গা, পাঠক হিসেবে আমরাও তার সেই আনন্দ-উচ্ছ্বাস অনুভব করি। দু'দুবার কেনিয়া গিয়ে বারাক তার পিতৃপুরুষের কাছের-দূরের প্রায় সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করেন। এমনকি পরেরবার যখন যান, সঙ্গে নিয়ে যান তার বাগদত্তা মিশেলকে এবং বিয়েটাও সারেন সেখানে।
১৯৬৩ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়া কেনিয়ার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পুরো একটি চিত্র পাওয়া যাবে এ বইটিতে। এসব যে বারাক জোর করে তার লেখায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন তা কিন্তু নয়, সবই এসেছে তার পূর্বপুরুষের মূলত পিতার জীবনকথা বয়ান করতে গিয়ে। আমাদের মতোই একটি দরিদ্র দেশ কেনিয়া, দুর্নীতি যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তার ওপর রয়েছে ছোট-বড় ৪০টি ভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং তাদের মধ্যে বিবাদ। কেনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশটাই বিদেশিদের হাতে। সেই ব্রিটিশ ডাক্তারের মুখ থেকে শোনা কেনিয়ার স্বাস্থ্যসেবার চিত্রটিও বারাক আমাদের জানিয়ে দেন। লোকজন প্রতিরোধযোগ্য রোগে ভুগে মারা যাচ্ছে, যেমন আমাশয়, চিকেন পক্স। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভয়াবহ হয়ে দেখা দিয়েছে এইডস_ অবস্থাটা এমনই মহামারী আকার ধারণ করেছে, কোনো কোনো গ্রামে এ হার পেঁৗছেছে শতকরা ৫০ ভাগে। আর হ্যাঁ, সেখানকার মানুষের খাবার-দাবারও এই ভারতবর্ষের মতো, মসলা প্রধান। 
বারাক ওবামার বইটি লেখার পেছনের বিষয়ে দু-চার কথা বলে শেষ করি। বারাক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়াকালে 'হার্ভার্ড ল রিভিউ'-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এটি খুবই সম্মানজনক পদ। এটিই ছিল কোনো কালো আমেরিকানের প্রথম 'হার্ভার্ড ল রিভিউ'-র প্রেসিডেন্ট হওয়া। এক প্রকাশক বিষয়টাকে কাজে লাগাতে চাইলেন। তিনি বারাককে একটি আত্মজীবনী লেখার অনুরোধ করেন। এজন্য বিরাট অঙ্কের আগাম টাকাও দেন। ১৯৯৫ সালে 'ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার' প্রকাশিত হয়। ২০০৪ সালে বইটি পরিণত হয় বেস্ট সেলারে। আর ১৯৯৬ সালে আফ্রিকান-আমেরিকান বারাক 
ওবামা ইলিনয় রাজ্যের সিনেটর নির্বাচিত হন। তারপর বাকিটা আজ ইতিহাস।
 

হাসান জাফরুল

১৯ মে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিনে মম লিখিত 'পদ্মানদীর মাঝির বাস্তবতার পূর্ণপাঠ' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ফ্লোরা সরকার এ লেখার প্রতিক্রিয়ায় একটি লেখা লেখেন 'পদ্মানদীর মাঝিরা কি শুধুই পদ্মানদীর মাঝি' শিরোনামে। তিনি ওই লেখায় কিছু অভিযোগ তোলেন এবং নিজের মতো করে লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করেন। এখানেই থেমে না থেকে পদ্মানদীর মাঝির বয়ানও দিয়ে দিয়েছেন এবং একজন তত্ত্বকার বা মহাপুরুষের জন্য আক্ষেপ পর্যন্ত করেছেন যে মাঝিদের দুর্দশা থেকে বাঁচাবে! যাই হোক, ফ্লোরা সরকারকে ধন্যবাদ তার মতামত সরলমনে খোলাখুলি প্রকাশ করার জন্য। আমি তার লেখা সম্পর্কে একমত নই, কারণ তার অনেক মতামত খাপছাড়া, শিশুসুলভ, পরস্পরবিরোধিতায় আক্রান্ত।

ফ্লোরার লেখা পড়তে গিয়ে কতক জায়গায় খুবই আশ্চর্য হয়েছি [এমনকি স্তম্ভিতও হয়েছি, তবে তার লেখা পড়ে নয় বরং তার স্তম্ভিত হওয়ার ক্ষমতা দেখে!] 'অস্বস্তিকর' এই শব্দ বন্ধে আপত্তি তুলতে। কারণ মানিক সম্পর্কে এটা কোনো নতুন মূল্যায়ন নয়। মানিক সম্পর্কে অগ্রজদের দুই-চারটে মূল্যায়ন পড়ার অভিজ্ঞতা থাকলেই তা জানার কথা। যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মূল্যায়ন – 'মধ্যবিত্তের জন্য এত পীড়াদায়ক লেখক আর হয় না।… যে জীবনযাপন করছি আমরা মধ্যবিত্তরা তাকে এমন ন্যাংটা করে, এমন অসহায় করে আর কেউই উপস্থিত করেননি।'

[মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : রাগী চোখের স্বপ্ন - আখতারুজ্জামান ইলিয়াস] হ্যাঁ, এই হচ্ছেন মানিক – যিনি আমাদের অস্বস্তি অনবরত উগড়ে দেন – তবুও আমরা তাকে পড়ি। পড়তে বাধ্য হই। ঠিক যেমন জীবনযাপন করতে বাধ্য হই! আর আমি প্রবন্ধে বলতে চেয়েছি শুধু বিষয় নয়, ভাষা কি শব্দচয়নেও এই অস্বস্তি কীভাবে চালান তা দেখানোর চেষ্টা করেছি। আর 'অস্বস্তিকর' শব্দ নিয়ে ফ্লোরা যে নিজের কল্পনা ক্ষমতা ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছেন, মন্তব্য করেছেন তা নিয়ে আর কথা বাড়ানোর দরকার মনে করছি না। এবার আসি রাজনৈতিক প্রসঙ্গে – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার বিষয় আমার প্রকাশের ধরন বিবেচনা করে রাজনৈতিক বলেছি। যদিও মানিক ১৯৪৪ সালে পার্টি রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন। তবে এর আগেও তিনি রাজনীতিবিমুখ লেখক ছিলেন না – এটাই ছিল আমার দাবি। সে জন্যই প্রথমেই আমি নগুগি ওয়া থিয়াংগোর উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছি। ফ্লোরার দৃষ্টিতে তা পড়ল না… কি দুঃখের! তার চোখে এটাও পড়ল না যখন আমি পদ্মানদীর মাঝির ব্যাখ্যা করেছি তাও রাজনৈতিক ব্যাখ্যা। হোসেন মিয়া, তার স্বপ্ন এবং তার সঙ্গে মাঝিপাড়ার সম্পর্কের ধরন-ধারণ তুলনা করে কলোনিয়াল পর্বের ইতিহাসের রূপক হিসেবে এই উপন্যাসকে দেখাতে চেয়েছি। বোধহয় ফ্লোরার ধারণায় কলোনিয়াল পর্ব একটি অরাজনৈতিক ব্যাপার! আর আশ্চর্যের বিষয় তিনি যে লেখাটি (কেন লিখি) থেকে উদ্ধৃতি টেনেছেন তা ১৯৪৪ সালে লেখা, যে বছর মানিক কমিউনিস্ট পার্টিতে জয়েন করেন। আশ্চর্য না! অরাজনৈতিক বানানোর অপচেষ্টার মূর্ত প্রতিবাদ তো ওই লেখাটিই! আর তা ছাড়া ওই উদ্ধৃতির 'এই জীবন কোন ছকের…' এগুলো মানিকের লাইন নয় – ছাপার ভুল? নাকি লেখকের আলস্য? আল্ল­াই জানেন কোনটা ঠিক। 'এই জীবন কোন ছকের…' এই চিরন্তন সত্য লাইনগুলো তার লেখায় দুই বার ব্যবহার করেছেন। এ ধরনের বাক্য যে কোনো লেখক সম্পর্কে মন্তব্য করার সময় ব্যবহার করা যায়। এমনকি এ সময়ের খুব স্বস্তিদায়ক লেখক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস আলোচনায় এ লাইনগুলো অনায়াসে ঢুকানো যাবে! তবে এ বাক্য মানিকের সাহিত্য সম্পর্কে কোনো আলাদা বিষয় উদ্ভাসিত করে না। আর ফ্লোরা রাসুর মধ্যে তার ছকের ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবে বুঝান কিন্তু হোসেন মিয়া কোন ছকে পড়েন? হোসেন মিয়া তো ছক তৈরি করেন, নাকি? তার ব্যাখ্যা কই? এসব ভারি ভারি কথা ভুল ব্যবহার কত আলগা পটকা হয়ে পড়ে!

এবার আসি যন্ত্রবিজ্ঞানের দীক্ষায় দীক্ষিত প্রসঙ্গে : তিনি লিখেছেন, 'হাতে একটি কম্পাস থাকলেই হোসেন মিয়াকে বিজ্ঞান শিক্ষায় দীক্ষিত মানুষ বলা যায় না।' এ লাইনের মর্মার্থ আমি বুঝিনি তবে এটা বুঝেছি – হাতে একটি কলম থাকলে যা ইচ্ছে তা-ই লেখা যায়! কারণ পুরো উদ্ধৃতিটা আহমদ ছফার বিখ্যাত প্রবন্ধ 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র' থেকে নিয়েছি। অথচ তিনি আমার কথা ভেবে রোষ ঢেলে দিয়েছেন! এ রোষ সইব কেমনে? কারণ লেখায় প্রবন্ধের নামও উল্লে­খ ছিল – অথচ ফ্লোরার চোখ এড়িয়ে গেল – এত অমনোযোগ! আশ্চর্য! তবে আমি আহমদ ছফার এ প্রবন্ধকে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ মনে করি। আমার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এ প্রবন্ধের ঋণ অসীম। যদিও আহমদ ছফার সঙ্গে আমার সিদ্ধান্তের তফাত আছে এ কথা প্রবন্ধে বলেছিও। যাই হোক, এবার অন্য প্রসঙ্গে যাই। বাস্তবতা নিয়ে ফ্লোরার মন্তব্য – 'লেখকের আর একটা অভিমত মানিকের গল্প-উপন্যাসে প্রতিবেশের বর্ণনা পাওয়া যায় না। বাক্যটা পড়ে শুধু চমকালাম না স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম।' আমি দুঃখিত তাকে স্তম্ভিত করে দেওয়ার জন্য! আমি আসলে লেখনির স্টাইল সম্পর্কে বলেছি। 'কি' প্রকাশ করছে তা নয়, 'কীভাবে' প্রকাশ করছে তা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। অথচ ফ্লোরা 'কি' প্রকাশ করছেন [গাওদিয়া গ্রাম তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে] তা বুঝে আক্রমণ করেছেন। স্টাইল, ফর্ম, কনটেন্টের আলোচনার ভেদরেখা ঘোচালে তালগোল তো পাকাবেই! আর সবচেয়ে বড় কথা – আমি কোথাও বলিনি প্রতিবেশের বর্ণনা পাওয়া যায় না, বলেছি in detail পাওয়া যায় না। এভাবে উপস্থাপন করলে বাক্যের মানে তো পাল্টে যায় – তাই না। আমি বলেছি in detail এর বদলে টুকরো টুকরো দৃশ্য সম্পাদনার মাধ্যমে প্রতিবেশ ফুটিয়ে তোলার ঝোঁক দেখা যায়। সে জন্যই মানিকের গল্প-উপন্যাস এত গতিময়। আর তা ছাড়া আমি 'প্রাগৈতিহাসিক' থেকে কয়েক ছত্র তুলেও দিয়েছি – কই ফ্লোরা তো তার মোকাবিলা করলেন না, শুধু শুধু বাক্য ঝাড়লেন। সোভিয়েত পরিচালক আইজেন স্টাইনও একই পদ্ধতিতে তার সিনেমার ভাষা গড়ে তুলেছেন। দুই শিল্পীর মধ্যে কত মিল – দুজন কিন্তু একই সময়ের তবে তাদের মধ্যে অমিলও আছে। আমি শুধু মূলগত মিলটার কথা বললাম। আর ঋত্মিক ঘটকের মন্তব্য তুলে দিয়েছি যাতে মানিককে 'নিরেট বাস্তববাদী' হিসেবে পাঠ করার বিপদ টের পাই আর উল্টোদিকে মানিকও যে শ্রেণীর সীমা অতিক্রম করতে পারেননি তা ধরার জন্য। মাঝিদের সাংস্কৃতিক জীবন, সংকট, জীবনের তুল্যমূল্য বিচার অদ্বৈত মল্ল­বর্মণের 'তিতাস একটি নদীর নাম' এর  সঙ্গে পদ্মানদীর মাঝি মিলিয়ে দেখি তবেই আমাদের কাছে অনেক কিছু স্পষ্ট হবে। আমার মনে হয় – যদি আমরা পদ্মানদীর মাঝিকে নিরেট বাস্তববাদের আলোকে দেখি তবে এ উপন্যাসের মেধাবী দিকটি ধরতে পারব না। সে জন্যই একটা রূপক আকারে আমি পদ্মানদীর মাঝিকে পাঠ করতে চেয়েছি। ফ্লোরা বোধহয় মনে করেছেন – আমি মানিককে অবাস্তববাদী লেখক বলতে চেয়েছি। যাই হোক, এ রকম চিন্তার পেছনে আরো দুটি প্রধান যুক্তির কথা বলব – প্রথমত মানিকের নিজের সম্পর্কে নিজের বয়ান। 'দিবারাত্রির কাব্য'র ভূমিকায় লিখেছেন, 'বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলো অনুভূতি যা দাঁড়ায় সেই গুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে।' অর্থাৎ ভাব থেকে রূপ পান তিনি। ভিখু পাচী আনন্দ হেরম্ব হোসেন মিয়া এরা সবাই-ই এই ভাবধারায় নির্মিত। দ্বিতীয়ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবল ব্যক্তিত্ব উপন্যাসে উপস্থিত থাকে। এই উপস্থিতি কোনো নিরপেক্ষ উপস্থিতি নয়, – এ উপস্থিতি শ্লেষ করে, – মন্তব্য করে। উদাহরণ দেই- 'ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্ল­ীতে' (পদ্মানদীর মাঝি) বা 'কলকাতা শহর! মোটরে চাপিয়া কলকাতা শহর গাওদিয়ার দিকে চলিল' (পুতুলনাচের ইতিকথা)। বাস্তবকে কীভাবে ঔপন্যাসিকের ব্যক্তিত্ব- আক্রমণ করে, ভাঙে তাকে আরো প্রাণবন্ত এবং জান্তব করে প্রকাশ করে তা দেখানোর জন্য উদাহরণগুলি দিলাম। যাই, হোক এ নিয়ে আর কথা না বলি… এমনকি কমিউনিস্ট পার্টিতে জয়েন করার পর 'বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা' লেখেন যা পরে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন অন্যদের চাপে – তাও পুনর্পাঠ জরুরি। সোজা কথা, পাঠ পুনর্পাঠ ছাড়া বিকল্প তো নাই – তাই না?

এখন ফ্লোরার বক্তব্যের শেষে যে তথাকথিত ভাব-নির্যাস উপস্থিত তা নিয়ে দুটো কথা বলব। তার আগে বলি যথার্থ পর্যালোচনা ছাড়া আলগা পটকা মন্তব্য করে তিনি আমার বক্তব্য খারিজ করেছেন। উপন্যাসটাও মনোযোগ দিয়ে পড়েননি – না হলে দেখতেন স্বয়ং ঔপন্যাসিক তার সাধের – মাঝিদের তথাকথিত প্রতিশ্রুত ভূমি ময়নাদ্বীপকে উপনিবেশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আমি শুধু 'কেতুপুর' যেভাবে চিত্রায়িত হয়েছে তার প্রেক্ষিতে তাকেও উপনিবেশ বলেছি- হোসেন মিয়া, তার স্বপ্ন এবং কেতুপুরের মাঝিদের কল্পনা সংগ্রামের তুলনা করে, আর সবচেয়ে বড় কথা এই স্বপ্নে কুবেররা নিষ্ক্রিয় অংশীদার মাত্র – তাই কেউ ওই দ্বীপে যেতে চায় না। আর ফ্লোরার মনে হয়েছে – সেই দ্বীপে সবাই আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে যায়। 'হোসেন মিয়া দ্বীপে আমারে নিবই কপিলা, একবার জেল খাইটা পার পামু না। ফিরা আবার জেল খাটাইব।' কুবেরের এই অসহায় আর্তি তার চোখে পড়ে না। হায় এত বিকৃত পাঠ, আর শেষে বুদ্ধিজীবী হিসেবে মাঝিদের মেরুদন্ড সোজা রাখার নিদান বাতলেছেন তা খুবই হাস্যকর। একজন তত্ত্বকার বা ত্রাণকর্তার প্রত্যাশা তার! তাহলে নাকি আর ময়নাদ্বীপের প্রয়োজন হবে না! ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত এক উপন্যাসের ওপর ভর করে তিনি পথ বাতলেছেন। হায়রে বাস্তবতা, তার আবার পাঠ! আমাদের চারপাশের 'আকাড়া বাস্তবতা' আর 'সাহিত্যে উপস্থাপিত বাস্তবতা'র মধ্যে গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছেন। মানিককে 'নিরেট বাস্তবতার' বদ্ধ জলাশয়ে আটকে ফেলে পরম আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন। যাই হোক, ফ্লোরার শিরোনাম 'পদ্মানদীর মাঝিরা কি শুধুই পদ্মানদীর মাঝি' বেশ হয়েছে। এটা আমিও বলতে চেয়েছি আমার প্রবন্ধে। তবে বাস্তবতার জন্য হাহাকার করে এই শিরোনাম দেওয়া – একেবারে খাপছাড়া ব্যাপার আর কি। আশ্চর্য লাগলেও তাকে আবারো ধন্যবাদ – অন্তত শিরোনামের জন্য।

বাংলাদেশের ছোটগল্প একটি আন্ত:জরিপ

বি শ্ব জি ৎ ঘো ষ

রেনেসাঁস-উত্তরকালে, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার পরম বিকাশের যুগে, আধুনিক মানুষের জীবনে দেখা দেয় বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য এবং সীমাহীন জটিলতা। আধুনিক মানবচৈতন্যের সমুদ্রবিস্মৃতি ও বিভঙ্গতা, বহুভুজ বিসংগতি ও বিপর্যয়, অন্তর্গূঢ় বেদনা ও উজ্জ্বল আশাবাদ – এইসব প্রবণতা প্রকাশের অনিবার্য মাধ্যম হিসেবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে নতুন শিল্প-আঙ্গিকরূপে ছোটগল্পের আত্মপ্রকাশ। পুঁজিবাদী সভ্যতার অভ্যন-র সীমাবদ্ধতার চাপে, সময়ের শাসনে মানুষ যতোই যান্ত্রিক হয়েছে, ছোটগল্প-সাহিত্যের বিকাশ ততোই হয়েছে ঋদ্ধ। পূর্ণ জীবন নয়, বরং বৈরী পৃথিবীতে জীবনের খণ্ডাংশই মানুষের কাছে প্রাধান্য পেল। এ অবস্তায় উপন্যাসের পরিবর্তে ছোটগল্প উঠে এলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কেননা, একক অনুষঙ্গের আধারেই ছোটগল্পে ফুটে উঠলো পূর্ণ জীবনের ব্যঞ্জনা – পদ্মপাতার শিশিরে যেমন হেসে ওঠে প্রভাতের সম্পূর্ণ সূর্য।
উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেও আদি উৎসভূমি ইউরোপ। ইউরোপীয় সমাজে প্রবহমান রূপকথা, লোকগাথা বা রোমান্সকাহিনি – যা ছিল মানুষের মনোরঞ্জনের অন্যতম মাধ্যম – ইতালীয় রেনেসাঁসের পর রূপান-রিত হয় নতুন চেতনায়, নব-প্রতিনব জিজ্ঞাসায়। বোক্কাচ্চিও, চসার, র‌্যাবলে, সারভান্টেসের সামূহিক সাধনায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো ছোটগল্পের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান কাহিনি-চরিত্র-প্লট আর সাবলীল সংলাপরীতি।১ বস'ত, এঁরাই আধুনিক ছোটগল্পের প্রত্ন-উৎসের জনয়িতা; এঁদের সাধনার সরণি ধরেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে ক্রমে আবির্ভূত হয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের প্রধান ছোটগাল্পিকরা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ফ্রান্স-রাশিয়া-ইংল্যান্ড-আমেরিকায় ছোটগল্পের যে শিল্পিত বিকাশ ঘটেছে, তার প্রভাব পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, ভারতবর্ষেও। পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের প্রেরণায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় সংঘটিত হয়েছিল সীমাবদ্ধ নবজাগরণ। নবজাগরণের ফলে শিল্প-সাহিত্য-ধর্মচর্চা – সর্বত্র একটা বিপুল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। নতুন নতুন শিল্প-আঙ্গিকে পূর্ণ হতে থাকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গন। পঞ্চাশ-ষাটের দশকেই নাটক, প্রহসন, মহাকাব্য, গীতিকবিতা, উপন্যাস রচিত হলেও ছোটগল্পের আবির্ভাব বিলম্বিত হয়েছিল শতাব্দীর শেষ দশক অবধি। উনিশ শতকের নব্বুইয়ের দশকেই, প্রকৃত অর্থে, বাংলা ছোটগল্পের যাত্রা শুরু, এবং লেখাই বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) হচ্ছেন সে-যাত্রার পথিকৃৎ।

দুই
কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু মধ্যবিত্তশ্রেণির বিকাশ ঘটে উনিশ শতকের প্রারম্ভে, শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে নবজাগ্রত এই মধ্যশ্রেণির সাধনাতেই সূচিত হয় বাংলা ছোটগল্পের সমুদ্রসম্ভব বর্ণিল-যাত্রা। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে পূর্ববঙ্গের মুসলিম মধ্যবিত্তশ্রেণির বিকাশ হয়েছে শতবর্ষ-বিলম্বিত। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১) পূর্ববঙ্গের মুসলিম মধ্যবিত্তশ্রেণির বিকাশে রাখে ঐতিহাসিক অবদান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পূর্ববাংলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ নব্য-শিক্ষিতের সমবায়ে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকেই ক্রমবিকশিত হচ্ছিল ঢাকা শহরকেন্দ্রিক নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণি। পূর্ববাংলার নবজাগ্রত এই মধ্যবিত্তশ্রেণীর চেতনা্লাত কয়েকজন শিল্পীর সাধনায় রচিত হয়েছে বাংলাদেশের ছোটগল্প-সাহিত্যের প্রাথমিক ভিত্তি।
ঢাকা শহরকেন্দ্রিক নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণী মর্মমূলে সামন্ত-মূল্যবোধ ধারণ করেও বুর্জোয়া সমাজসংগঠনের চিন্তা-চেতনা, উদার মানবতাবোধ এবং যুক্তিবাদে আকৃষ্ট হয়ে ১৯২৬ সালে গঠন করল 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ।' অপরদিকে মার্কসবাদে বিশ্বাসী অথচ বুর্জোয়া মানবতাবাদে প্রত্যয়ী লেখক ও শিল্পীদের মানসভূমিতে পূর্ববঙ্গ উপ্ত করেছে স্বাতন্ত্র্যের বীজ; এবং এঁরাই স্বাতন্ত্র্যাভিলাষী পূর্ববাংলার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে আধুনিক জীবনচেতনায় অনেকাংশে উদ্বুদ্ধ করেছে।
প্রাক্‌-সাতচল্লিশ পর্বে পূর্ববঙ্গের ছোটগাল্পিক-চেতনাপুঞ্জ প্রবাহিত হয়েছে দুটি ভিন্ন স্রোতে। একটি স্রোতের উৎস ছিলেন সামন- মূল্যবোধে বিশ্বাসী গল্পকাররা; অন্যটি সৃষ্টি হয়েছে উদার বুর্জোয়া মানবতাবাদে প্রত্যয়ী কথাকোবিদদের সাধনায়। প্রথম স্রোতটি নির্মাণ করেছেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (১৯০৪-৮৬), বন্দে আলী মিয়া (১৯০৮-৭৯) প্রমুখ; আর দ্বিতীয়টি আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), আবুল ফজল (১৯০৩-৮৩), আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৯), আবু রুশ্‌দ (১৯১৯-), সিকান্‌দার আবু জাফর (১৯১৯-৭৫), সোমেন চন্দ (১৯২০-৪২), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌ (১৯২২-৭১), শওকত ওসমান (১৯১৭-৯৮), আবু জাফর শামসুদ্দীন (১৯১১-৮৮), শামসুদ্দীন আবুল কালাম (১৯২৬-৯৭) প্রমুখ। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, অসম সমাজবিকাশের কারণে বিশ শতকের সূচনাকাল থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত মুসলিম মধ্যবিত্তশ্রেণির মানসলোকে বুর্জোয়া ভাবধারার ভূমিকা ছিল প্রগতিশীল এবং সত্যস্পর্শী।২
মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন কিংবা বন্দে আলী মিয়ার গল্প শিল্পমূল্যে সমৃদ্ধ নয়, কিন্তু পূর্ববাংলার গল্প-সাহিত্যের বিকাশধারায় তাঁদের প্রয়াস ঐতিহাসিক কারণে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের গল্পে পূর্ববাংলার মুসলিম সমাজের ধর্মাশ্রিত সংস্কার্লিগ্ধ প্রথাচল জীবনপ্রত্যয় রূপায়িত হয়েছে সরল প্লটের আশ্রয়ে, সাবলীল ভাষায়। সামন্ত মূল্যবোধের প্রতি প্রবল আসক্তি এবং উনিশ শতকী জীবনধারণা তাঁদের গল্প-সাহিত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ধানের মঞ্জুরী (১৯৩২), শিরণী (১৯৩৩), পয়লা জুলাই (১৯৩৪), শিরোপা (১৯৩৭); এবং বন্দে আলী মিয়ার মেঘকুমারী (১৯৩৬), মৃগপরী (১৯৩৪), হরিণ (১৯৩৯), অরণ্যের বিভীষিকা (১৯৪৫) প্রভৃতি ছোটগল্প-সংকলনের নাম।
প্রাক্‌-সাতচল্লিশ পর্বেই বাংলা কথাসাহিত্যের ধারায় আবুল ফজলের দীপ্র আবির্ভাব। যুদ্ধোত্তর বিপর্যয়, কল্লোলীয় ভাবোচ্ছ্বাস ও মনোবিশ্লেষণ এবং মুসলিম সমাজের সংস্কারাচ্ছন্নতা-স্বপ্নচারিতা নিয়ে গড়ে উঠেছে আবুল ফজলের গল্পজগৎ। কল্লোল, কালিকলম, প্রগতির সাহিত্যধারায় যে মননঋদ্ধ নাগরিক চেতনার উদ্বোধন, মুসলিম কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে আবুল ফজলের রচনাতেই তার প্রথম উদ্ভাসন।
ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপাত্মক গল্প-রচনায় আবুল মনসুর আহমদের কৃতিত্ব সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক ব্যঙ্গ রচনায় তিনি সিদ্ধহস-। সমাজের নানা দোষ-ত্রুটি ও অসংগতি তিনি ব্যঙ্গের আচরণে উন্মোচন করেন। ভণ্ড ধার্মিক, অসৎ রাজনীতিবিদ এবং কপট সমাজসেবকের বহুমাত্রিক রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি আবুল মনসুর আহমদের ছোটগল্পে।৩ সাবলীল ভাষা, চরিত্রানুগ সংলাপ এবং সরল প্লট আবুল মনসুর আহমদের গল্পের জনপ্রিয়তার মূল কারণ। আয়না (১৯৩৫), ফুড কনফারেন্স (১৯৫০) প্রভৃতি গ্রনে' আবুল মনসুর আহমদ সমাজের নানা অসংগতি তুলে ধরছেন এবং একই সঙ্গে প্রত্যাশা করেছেন মানবিক অন-ঃসংগতির উদ্বোধন।
মুসলিম মধ্যবিত্তের সংস্কারচেতনা ও চিত্তের প্রবঞ্চনা, সাগরিক মধ্যবিত্তের আত্মগ্লানি ও জীবনবোধের দীনতা, এবং দেশবিভাগের আবেগ-উচ্ছ্বাস-উদ্বেগে সিক্ত আবু রুশ্‌দের গল্পভুবন। দেশবিভাগের পূর্ববর্তী-পরবর্তী সামাজিক সংকট নিয়ে গল্প-উপন্যাস রচনায় তিনি অতি-উৎসাহী, কিন' সে-উৎসাহ ইতিহাসচেতনা ও সমপ্রদায়-নিরপেক্ষতার অভাবে প্রায়ই মানবরসে হতে পারেনি জারিত। মধ্যবিত্ত জীবনের নানা অসংগতি ও অন-ঃসারশূন্যতা আবু রুশ্‌দের প্রিয় বিষয়। শাড়ী বাড়ী গাড়ী (১৯৬৩) এবং মহেন্দ্র মিষ্টান্ন ভাণ্ডার (১৯৭৪) গল্পগ্রনে' নাগরিক মধ্যবিত্তের চিত্তপ্রবঞ্চনা অসংগতি এবং অনন্বয় শিল্পিত ভাষ্যে রূপলাভ করেছে। বিভাগ-পূর্বকালে রচিত রাজধানীতে ঝড় (১৯৩৮) গল্পগ্রনে' রোমান্টিক জীবনচেতনার যে প্রকাশ ঘটেছিল, পরবর্তীকালে গল্পে সে-জগৎ ছেড়ে আবু রুশ্‌দ মুসলিম মধ্যবিত্তের বাস-বজীবনে করেছেন বিচরণ। ছোটগাল্পিক সংহতি এবং নাট্যিক ব্যঞ্জনায় আবু রুশ্‌দের গল্প বিশিষ্ট।
দক্ষিণ বাংলার গরিব-নিুবিত্ত মানুষের প্রাত্যহিক জীবনসংগ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে শামসুদ্দীন আবুল কালামের গল্পসাহিত্য। যুদ্ধোত্তর-পটে মানুষের অন-হীন দুর্ভোগ-নির্বেদের গল্পরূপ সৃজনেও তিনি রেখেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর। 'পথ জানা নাই', 'দুই হৃদয়ের ঢেউ', 'অনেক দিনের আশা', 'রক্তের স্বাদ' প্রভৃতি গল্প তাঁর প্রখর সমাজবোধের পরিচায়ক। ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পটভূমিতে লেখা 'রক্তের স্বাদ' গল্প একটি বিশিষ্ট সৃষ্টি। বাংলা কথাসাহিত্যে দাঙ্গার পটে লেখা গল্প-উপন্যাসের মধ্যে 'রক্তের স্বাদ' দাবি করতে পারে বিশিষ্টতা। বরিশালের উপভাষা শামসুদ্দীন আবুল কালামের ছোটগল্পে অর্জন করেছে শিল্পিত লাবণ্য। তাঁর অধিকাংশ গল্পে ব্যবহৃত হয়েছে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা।
সোমেন চন্দের গল্প বাংলা ছোটগল্পের ধারায় সংযোজন করেছে নতুন মাত্রা। বাংলা সাহিত্যে সমাজবাদী চিন-ার শিল্পরূপ নির্মাণে তিনি পালন করেছেন পথিকৃতের ভূমিকা। নিরন্ন খেটে-খাওয়া মানুষর প্রাত্যহিক জীবনযন্ত্রণার ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর ছোটগল্পে। সোমেন চন্দের গল্পে মানুষের মুক্তিকামনা উচ্চারিত হয়েছে, ধ্বনিত হয়েছে মানবাত্মার বিজয়গাথা। রাজনীতি-সচেতনতায় এবং সমাজকাঠামো পরিবর্তনের বাসনায় সোমেনের গল্প বিশিষ্ট ও ব্যক্তিক্রমধর্ম চিহ্নিত। এ প্রসঙ্গে তাঁর 'বনস্পতি', 'একটি রাত', 'ইঁদুর', 'সঙ্কেত' প্রভৃতি গল্প স্মরণ করা যায়।
উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র শিল্পনৈপুণ্য একক অনতিক্রান্ত এবং প্রাতিস্বিকতাচিহ্নিত। শিল্পবোধ ও জীবনচেতনার প্রশ্নে পূর্বাপর সতর্ক, সপ্রতিভ এবং বিশ্ববিস্তারী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র গল্পসমূহ বাংলা সাহিত্যের ধারায় সংযোজন করেছে স্বকীয় মাত্রা। যুদ্ধোত্তর বিনাশী প্রতিবেশে বাস করেও মানবীয় অসি-ত্বের ক্লানি-হীন সাধনায় তিনি চিলেন সি'তপ্রাজ্ঞ। নিরস্তিত্বের শূন্যতায় ফুরিয়ে যাওয়া জীবন নয়, অন্ধকার ভেঙে ভেঙে অসি-ত্বের দায়িত্বশীল স্বাধীন সত্তায় উত্তীর্ণ হওয়াই তাঁর ছোটগল্পের মৌল বৈশিষ্ট্য। গল্পের বিষয় নির্বাচনে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌ ছিলেন বাংলাদেশর জনজীবনসম্পৃক্ত, কিন্তু বক্তব্য ও প্রকরণে সর্বজনীন, বিশ্বপ্রসারিত, স্বনিষ্ঠ এবং পরীক্ষাপ্রিয়। চেতনা ও আঙ্গিকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র গল্পসমূহ যেন তাঁর পরিব্যাপ্যমান জীবনবোধের অনুবিশ্ব। মানুষের অস্তিত্ব-অভীপ্সা, নৈঃসঙ্গ্য, ভয়-অনুশোচনা প্রভৃতি তাঁর গল্পের উপজীব্য।৪
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র অধিকাংশ গল্পই মনস-ত্ত্বধর্মী ও মনোময়। সমাজের বহির্বাস্তবতার চেয়ে মানবজীবনের অন্তর্বাস্তবতার জগতে বিচরণ করতে তিনি অধিক উৎসাহী। তাঁর গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের অন-র্জীবনের ইতিকথা, হার্দিক অগ্ন্যুৎপাত। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন ডিটেইলস নিয়ে তাঁর সৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়েছে কখনো কখনো, যেমন 'নয়নচারা'। পঞ্চাশের মন্বন-র ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এই গল্পে ময়ূরাক্ষীর স্মৃতিময় জনপদ উন্মোচিত যেন। গ্রামীণ জীবনের নানা কুসংস্কার, ধর্মীয় অন্ধতা এবং ধর্মজীবীদের ভণ্ডামি ওয়ালীউল্লাহ্‌র গল্পের একটি বহু-ব্যবহৃত বিষয়। 'নয়নচারা', 'মৃত্যুযাত্রী', 'খুনী', 'দুই তীর', 'একটি তুলসী গাছের কাহিনী', 'পাগড়ি', 'সীমাহীন' এক নিমেষে' প্রভৃতি গল্পে ওয়ালীউল্লাহ্‌র ছোটগাল্পিক প্রতিভার উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ সুপরিস্ফুট। তাঁর গল্প প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্যে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র নির্মাণ। ওয়ালীউল্লাহ্‌র গল্পের ভাষা বিষয়ানুগ, চিত্রাত্মক, গীতোময় এবং অলঙ্কারসমৃদ্ধ। 'চিন-াশীল চিত্রস্রোত, অবচেতনার ভগ্নক্রমপ্রবাহ' ওয়ালীউল্লাহ্‌র গদ্যশৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
বিভাগ-পূর্বকালে ছোটগাল্পিক হিসেবে আবির্ভূত হলেও শওকত ওসমানের প্রথম গল্পসংকলন প্রকাশিত হয় পঞ্চাশের দশকে। চল্লিশের দশক থেকে নব্বুইয়ের দশক পর্যন- বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় আবহ তাঁর গল্পে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় হয়ে আছে বন্দি। প্রথম দিকে মুসলিম মধ্যবিত্ত-নিুবিত্ত জীবনপ্রাঙ্গণ থেকে চয়ন করেছেন তিনি গল্পের উপাদান। এ পর্বে রোমান্টিকতা দ্বারাও প্রভাবিত ছিল তাঁর গল্পের চরিত্রেরা। কিন' ষাটের দশক থেকে তাঁর গল্পে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মোল্লা- মৌলভি-পাদ্রিদের ভণ্ডামি ও ধর্মব্যবসা আসতে থাকে ব্যাপকভাবে। ব্যঞ্জনাধর্মী রূপক ও প্রতীকের আশ্রয়ে শওকত ওসমান প্রায়ই প্রকাশ করেন তাঁর প্রগতিশীল চিন-াস্রোত, এবং সে-চিন-াস্রোতে সিক্ত হয়ে ওঠে তাঁর পুরুষেরা, তাঁর নারীরা। সদর্থকচেতনায় উত্তীর্ণ হয়ে তাঁর গল্পের নায়কেরা প্রায়ই মানবিক মহিমায় জাগ্রত হয়, নেতি আর নাসি-র জগতে বাস করেও তারা ইতিবাচক জীবনবোধে উজ্জীবিত হয়ে ঘোষণা করে মানবিকতারই জয়গান। মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালে রচিত তাঁর গল্পে এসেছে নতুন মাত্রা। মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ এবং যুদ্ধোত্তর সমাজবাস-বতা এ-সময় অঙ্গীভূত হয় তাঁর ছোটগল্পে। জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৭৫), মনিব ও তাহার কুকুর (১৯৮৬), ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৯০) প্রভৃতি গল্পগ্রনে' শওকত ওসমান বাংলাদেশের যুদ্ধোত্তর সমাজবাস-বতা নৈপুণ্যের সঙ্গে করেছেন উন্মোচন। আঙ্গিক-নিরীক্ষা, চরিত্রানুগ ভাষা-প্রয়োগ এবং ব্যঞ্জনাধর্মী রূপক-প্রতীক ব্যবহার শওকত ওসমানের গল্পের অন্যতম সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য। বিষয়াংশের সঙ্গে প্রকরণের শিল্পিত সম্পর্কে শওকত ওসমানের গল্প বাংলা সাহিত্যের ধারায় বিশিষ্টতার পরিচয়বাহী।
বিভাগপূর্ব কালেই গল্পকার হিসেবে আবু জাফর শামসুদ্দিনের দীপ্র আবির্ভাব। সমাজসচেতনতা, সংস্কারমুক্ত জীবনপ্রত্যয় এবং উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আবু জাফর শামসুদ্দিনের জীবনার্থের মৌল চারিত্র্য। তাঁর ছোটগল্প ওইসব মানসতার শৈল্পিক অঙ্গীকারে অর্জন করেছে বিশিষ্টতা। প্রথম দিকের গল্পে তিনি গ্রামীণ জীবনের দৈনন্দিনতাকে নির্বাচন করেছেন প্রধান শিল্প-উপাদান হিসেবে। জীবন (১৯৪৮), শেষ রাত্রির তারা (১৯৬১) প্রভৃতি সংকলনে পল্লিবাংলার জীবন ও প্রকৃতি হয়ে আছে উদ্ভাসিত। শেষ পর্বের গল্পে নাগরিক মধ্যবিত্ত-নিুবিত্ত মানুষের চিত্র এসেছে, তবে কখনো নির্বাসিত হয়নি পল্লিজীবন। তাঁর গল্পে উচ্চারিত হয়েছে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ। সামাজিক বৈষম্য আর অসংগতিকে কখনো কখনো তীব্র বিদ্রূপবাণেও তিনি বিক্ষত করেছেন, সমাজে-সংসারে কামনা করেছেন প্রার্থিত মুক্তি ও মানবিক অন-র্সংগতি। তাঁর এই আকাঙ্ক্ষা 'মৃত্যু ও প্রলাপ' গল্পের সাবেরের মুখে উচ্চারিত যেন -
আমার মত অন-তঃ গড়ে বিশটা করে শিশু প্রত্যেকে জন্ম দিলে আগামী পনের বৎসরের মধ্যেই সেই যে বলেছি সংঘর্ষটার কথা তা লাগতে পারে এবং তাহলে এই অতি উঁচু নীচু ভেদটা দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হতে পারে ত?
বিষয়াংশ ও ঘটনাবিন্যাসের প্রতি আবু জাফর শামসুদ্দীন মনোযোগী শিল্পী কিন' প্রকরণনিরীক্ষায় তাঁর সেই মনোযোগ বা সতর্কতা দুর্লক্ষ্য। প্রথাশাসিত পথেই তিনি গল্পের আঙ্গিক বিন্যাস করেছেন, নতুন নিরীক্ষায় হননি অগ্রসর। আঙ্গিকগত পরীক্ষায় তাঁর সামান্য প্রয়াসটুকুও হতে পারেনি সার্থকতাবিমণ্ডিত।
মুনীর চৌধুরী বেশ কিছু সার্থক গল্প রচনা করলেও তাঁর কোনো গল্পগ্রন' প্রকাশিত হয়নি। নাটকের মতো ছোটগল্পেও মুনীর চৌধুরীর প্রাতিস্বিকতা সহজেই লক্ষযোগ্য। প্রগতিশীল সমাজচেতনা এবং কৌতুকের আশ্রয়ে সামাজিক অসংগতির চিত্ররূপায়ণই মুনীর চৌধুরীর গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ-প্রসঙ্গে তাঁর 'খড়ম', 'মানুষের জন্য', 'নগ্ন পা', 'বাবা ফেকু' প্রভৃতি গল্প স্মরণীয়।
আলোচ্য পর্বেই গল্পকার হিসেবে আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং সিকান্‌দার আবু জাফরের আবির্ভাব। দেশবিভাগের পূর্বেই প্রকাশিত হয় উভয়ের প্রথম গল্পগ্রন'। আবুল কালাম শামসুদ্দীনের ত্রিস্রোতা (১৯৪৪) এবং সিকান্‌দার আবু জাফরের মাটি আর অশ্রু (১৯৪৬) মধ্যবিত্ত-নিুবিত্ত মানুষের প্রাত্যহিক জীবনচর্চার গল্পভাষ্য। পরবর্তীকালে এঁরা কেউই আর ছোটগল্প রচনা করেননি, যেমন করেননি মুনীর চৌধুরী।
তিন
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের ষড়যন্ত্রে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত 'পাকিস্তান' নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রের শৃঙ্খলে পূর্ববঙ্গের উঠতি মধ্যবিত্তশ্রেণির অগ্রযাত্রা হলো বাধাপ্রাপ্ত। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ববাংলার উঠতি পুঁজিবাদী গোষ্ঠী এবং নবজাগ্রত মধ্যবিত্তশ্রেণি অনুভব করলো তাদের অস্থিত্বের অন্তর্সংকট। পাকিস্তানি বৃহৎ পুঁজির আর্থিক স্বার্থেই পূর্ববাংলা রূপান্তরিত হলো আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামনবাদী একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে। ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মে সমাজবিকাশের এই প্রতিবন্ধকতা শিল্পীর চৈতন্যকে অনিবার্যভাবে প্রভাবিত করলো। ফলে বুর্জোয়া মানবতাবাদে প্রত্যয়ী শিল্পীর মানসলোকে উপ্ত হলো সংকটের বীজ। আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে পূর্ববাংলার প্রগতিশীল নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণির প্রথম প্রতিবাদ উচ্চারিত হলো ১৯৪৮ সালে। ১৯৫২ সালে সংঘটিত হলো ইতিহাস-সৃষ্টিকারী ভাষা-আন্দোলন। আমাদের রাজনীতি এবং সমাজ-সংস্কৃতির অন্তর্ভুবনে ভাষা-আন্দোলন সঞ্চার করলো স্বাধিকার-প্রত্যাশী চৈতন্য। বায়ান্নর রক্তিম প্রতিবাদ পূর্ববাংলার জনমনে যেমন তোলে ঊর্মিল আলোড়ন; তেমনি সামন্ত-মূল্যবোধসিক্ত মধ্যবিত্তশ্রেণির সুদৃঢ় পলল ভিতও করে তোলে শিথিল। মানবতাবাদী গণতান্ত্রিক এবং মার্কসীয় চেতনাপুষ্ট শক্তিসমূহ পূর্ববাংলার সমাজজীবনের প্রায় সকল স্তরে অতিদ্রুত প্রভাব বিস্তার করতে থাকে – যার ফলে ১৯৫৪-এর সাধারণ নির্বাচনে বেনিয়া-পুঁজি ও সামন্তশক্তির ধারক মুসলিম লীগ, সকল প্রয়াস সত্ত্বেও, পরাজিত হয়; এবং প্রগতিশীল শক্তি যুক্তফ্রন্ট অর্জন করে বিপুল বিজয়। অতঃপর ১৯৫৮-এর আগস্ট পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ বারবার মন্ত্রিসভার পতন সুগম করে দেয় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের পথ।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন প্রবর্তন-পূর্বকাল-পরিসর এদেশের সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি বিশেষ পর্যায়। তাই আলোচ্য সময়সীমায় রচিত ছোটগল্পসমূহ আমরা বাংলাদেশের ছোটগল্প-সাহিত্যের প্রথম পর্ব হিসেবে বিবেচনা করবো। সময়ের এই পর্ব-বিভাজন মোটেই স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান- নয়; সাতচল্লিশ-উত্তর পূর্ববাংলার আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিভাজন অবশ্যই সমাজসত্য-সম্মত।
বিভাগ-উত্তর কালে প্রথম দশকে ছোটগল্প রচনায় যাঁরা ব্রতী হন, তাঁদের মধ্যে সরদার জয়েনউদ্দীন (১৯১৮-৮৬), মিরজা আবদুল হাই (১৯১৯-৮৪), শাহেদ আলী (১৯২৫-), আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০১), আশরাফ সিদ্দিকী (১৯২৭-), মিন্নত আলী (১৯২৭-২০০২), আনিস চৌধুরী (১৯২৯-৯০), শহীদ সাবের (১৯৩০-৭১), আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী (১৯৩১-), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-), হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-৮৩), জহির রায়হান (১৯৩৩-৭২), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-), বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর (১৯৩৬-), আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ (১৯৩৮-) প্রমুখ শিল্পীর অবদান উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭, সময়ের এ-পর্বে প্রকাশিত ছোটগল্পসমূহ প্রধানত গ্রামকেন্দ্রিক ঘটনাংশ আশ্রয় করে নির্মিত হয়েছে। পূর্ববঙ্গের প্রশাসনিক কার্যক্রমের কেন্দ্র হলেও ঢাকা শহরের প্রকৃত নগরায়ণ ঐতিহাসিক কারণেই হয়েছে বিলম্বিত। ফলে আমাদের শিল্পসাহিত্যেও নাগরিক চেতনার প্রতিফলন, আলোচ্য পর্বে, প্রায় অনুপসি'ত। তবু আলোচ্য কালখণ্ডের ছোটগাল্পিকদের মধ্যে আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখের রচনায় নির্মীয়মাণ মহানগর ও তার জীবনবৈচিত্র্য উদ্ভাসিত হতে আরম্ভ করে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায়। পঞ্চাশের গল্পকার হিসেবে যাঁরা সুপরিচিত, তাঁদের প্রধান প্রবণতা সমালোচক নির্দেশ করেছেন এভাবে -
…তাঁরা ছিলেন প্রবলভাবে জীবনবাদী ও সমাজসংলগ্ন। তাঁদের গল্পের বিষয়ে যেমন দেশবিভাগ পূর্বকালের জীবনচিত্র রূপায়িত তেমনি আছে বিভাগ পরবর্তীকালের। উদ্বাস'সমস্যা, মন্বন-র, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দাঙ্গা ইত্যাদি নিয়ে তাঁরা গল্প লিখেছেন, তবে প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশের গ্রামজীবন। গ্রামের বা শহরের যে ধরনের বিষয় তখনকার গল্পকারেরা অবলম্বন করুন না কেন, গল্পে যাপিত জীবনের সংকট ও সমস্যার আলেখ্যই তাঁরা রচনা করেছেন। কোন কোন শিল্পীর রচনায় শ্রেণীসংগ্রামও প্রমূর্ত হয়েছে।৫
সরদার জয়েনউদ্দীনের গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে বাংলার গ্রামজীবন। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে স্বকালের সামাজিক অসংগতিকে চিত্রিত করতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাই তাঁর সৃষ্টিতে ইতিহাসবোধ ও সমকালচিন্তার যুগলস্রোত লক্ষণীয়। তাঁর গল্পের প্রধান উপজীব্য যুদ্ধ, দাঙ্গা, অসংগতি ও অসাম্য – আর এইসব বিরূপতা-বৈনাশিকতা থেকে মানবিক মুক্তিকামনা। সরদার জয়েনউদ্দীনের গদ্যরীতি সরল ও চিত্তাকর্ষক, প্লট জটিলতামুক্ত আর পরিচর্যা মূলত বর্ণনাধর্মী।
সত্তরের দশকে প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হলেও গল্পকার হিসেবে মিরজা আবদুল হাইয়ের আবির্ভাব পঞ্চাশের দশকে। সামাজিক অসংগতিকে ব্যঙ্গের মাধ্যমে তুলে ধরতে তিনি সিদ্ধহস-। সমস্ত প্রতিকূলতা ও অসংগতি অতিক্রম করে তাঁর চরিত্রেরা অন্তিমে উদ্ভাসিত হয় মানবীয় সম্ভাবনায়, উত্তীর্ণ হয় মানবিক পরমার্থবোধে। মিরজা আবদুল হাইয়ের ছোটগাল্পিক-পরিচর্যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য মনোবিশ্লেষণ ও আত্মকথনরীতি। তাঁর গল্পের ভাষা সাবলীল, সংহত এবং কৌতুকবোধসিক্ত।
মানবজীবনের মন্ময়প্রান্ত নিয়ে গল্প রচনায় শাহেদ আলীর উৎসাহ সমধিক।৬ কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৪) কিংবা তালিম হোসেনের (১৯১৮-৯৯) মতো ইসলামি মূল্যবোধ ও জীবনদর্শনে গভীর বিশ্বাস শাহেদ আলীর শিল্পীমানসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাই তাঁর গল্পে ওই মানসপ্রবণতার সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছে। সামাজিক বৈষম্য, কৃষকজীবনের দুর্গতি, ধর্মজীবীর ভণ্ডামি এবং ইসলামি মূল্যবোধ – এইসব বিষয় ও প্রবণতা নিয়ে গড়ে উঠেছে শাহেদ আলীর গল্পভুবন। যুদ্ধোত্তর পটে আবির্ভূত হলেও শাহেদ আলীর গল্পে আধুনিক জীবনযন্ত্রণার কোনো চিত্র রূপায়িত হয়নি। আধুনিক নগরসভ্যতার পরিবর্তে গ্রামীণ গণজীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-যন্ত্রণাই তাঁকে গভীরভাবে প্রাণিত ও পীড়িত করেছে। শিশু-মনস-ত্ত্বের গল্প হিসেবে শাহেদ আলীর 'জিবরাইলের ডানা' অর্জন করে বহুল প্রশংসা। 'সিতারা', 'মা', 'পুতুল', 'মহাকালের পাখনায়', 'একই সমতলে', 'অতীত রাতের কাহিনী' প্রভৃতি গল্প তাঁর ছোটগাল্পিক-প্রতিভার স্বাক্ষরবাহী। কাব্যময়তা, সংহতি এবং অনি-ম ব্যঞ্জনাসৃষ্টিতে শাহেদ আলীর গল্প বিশিষ্ট।
আবু ইসহাকের গল্পে রূপায়িত হয়েছে গ্রামীণ বাংলার নিুবিত্ত মানুষের সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না-আনন্দ-বেদনা আর দ্বন্দ্ব-ষড়যন্ত্র-সংগ্রামের কাহিনি। গল্পের শরীরে তিনি এঁকে দিয়েছেন গ্রামবাংলার সামাজিক অনাচার, অর্থনৈতিক শোষণ এবং ব্যক্তিক অসংগতির নানামাত্রিক চিত্র। ইতিবাচক জীবনবোধের আলোয় আবু ইসহাকের নায়কেরা সমস্ত অন্ধতা, কুসংস্কার আর শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে একটি সুন্দর সমাজপ্রতিবেশ নির্মাণে হয়েছে জাগ্রত। এ প্রসঙ্গে তাঁর 'বিস্ফোরণ', 'জোঁক', 'খুঁতি' প্রভৃতি গল্পের কথা উল্লেখ করা যায়। শ্রেণিসংগ্রামের শিল্পভাষ্য হিসেবে 'জোঁক' গল্প আবু ইসহাকের প্রগত জীবনবোধের পরিচয়বাহী। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র মতো আবু ইসহাকের গল্প বর্ণনাপ্রধান এবং প্রথাশ্রয়ী, সেখানে নেই আঙ্গিক-সংগঠন বা ভাষা নিয়ে সতর্ক কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছাপ।
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর গল্প-সাহিত্যের কেন্দ্রীয় বিষয় নাগরিক মধ্যবিত্তের প্রেম-অপ্রেম, আনন্দ-বেদনা আর স্বপ্ন-সংগ্রাম। তবে, বাংলাদেশের ছোটগল্পের কেন্দ্রীয় প্রবণতা গ্রামীণ জীবন সংলগ্নতা থেকে তাঁর গল্প একেবারে বিযুক্ত নয়। ছোটগাল্পিক সংহতি ও একমুখিতা তাঁর গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রোমান্টিক মানসপ্রবণতার প্রভাবে গাফ্‌ফার চৌধুরীর গল্পে আমরা লক্ষ করি কাব্যময়তা ও আবেগী পরিচর্যার আধিক্য। উপমারূপক উৎপ্রেক্ষায় সমৃদ্ধ গাফ্‌ফার চৌধুরীর গল্পভাষা। ইতিবাচক জীবনবোধের ছোঁয়ায় গাফ্‌ফার চৌধুরীর গল্প বিশিষ্ট ও উজ্জ্বল।
বাংলাদেশের ছোটগল্প-সাহিত্য যাঁদের সাধনায় সমৃদ্ধ ও উন্নত হয়েছে, হয়েছে প্রগতি ও শিল্পিত, আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁদের অন্যতম। আলাউদ্দিন আল আজাদের শিল্পীমানসের বিকাশরেখা স্পষ্টতই দুটো ভাগে বিভক্ত করা সম্ভব। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পূর্ব পর্যন্ত আলাউদ্দিন আল আজাদ ছিলেন সমাজমনস্ক শ্রেণিসচেতন প্রগতিশীল কথাশিল্পী। কিন' ষাটের দশক থেকে শ্রেণিচেতনা ও সমাজবাস-বতার পরিবর্তে মানুষের অবচেতন আকাঙ্ক্ষা, লিবিডোতাড়না এবং কালিক নির্বেদই হয়ে ওঠে তাঁর মানসদৃষ্টির মৌলসূত্র। জীবনদৃষ্টির এই পশ্চাৎগতি আলাউদ্দিন আল আজাদের ছোটগল্প-সাহিত্যের মৌলভূমিতে উপ্ত করেছে একটা বৃহৎ পরাভব ও সীমাহীন অবক্ষয়ের বীজ। ষাটের দশকে আজাদের পথ ধরেই বাংলাদেশের অনেক কথাশিল্পী অগ্রসর হলেন মনোবিশ্লেষণ, যৌনতা আর ভঙ্গিসর্বস্বতার বঙ্কিম পথে। অথচ, মানিক-প্রভাবিত আলাউদ্দিন আল আজাদ গল্প রচনা সূচনা করেন মার্কসীয় শ্রেণিধারণায় সুগভীর বিশ্বাস রেখে।
প্রথম পর্বের গল্পে আলাউদ্দিন আল আজাদের দেশ-কাল- শ্রেণিসচেতন মানসতার সুস্পষ্ট প্রকাশ লক্ষণীয়। জেগে আছি (১৯৫০), ধানকন্যা (১৯৫১), মৃগনাভি (১৯৫৩) প্রভৃতি গ্রন্থে শ্রেণিচেতনায় সজাগ থেকে তিনি নির্মাণ করেছেন মানবতার অপরাজেয় গৌরবগাথা। কিন' দ্বিতীয় পর্বের গল্পে মার্কসীয় শ্রেণিধারণা থেকে বিচ্যুৎ হয়ে তিনি জীবনের অন-ঃঅসংগতি সন্ধানে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন ও যৌনধারণায় আকৃষ্ট হলেন। জীবনদৃষ্টির এই পশ্চাৎগতি তাঁর গল্পের শিল্পসিদ্ধিকেও করেছে ক্ষুণ্ন। মনোবিকলন ও মনোগহনের শিল্পরূপ হিসেবে তাঁর অন্ধকার সিঁড়ি (১৯৫৮), উজান তরঙ্গে (১৯৫৯), যখন সৈকত (১৯৬৭), জীবন জমিন (১৯৮৮) প্রভৃতি সংকলনভুক্ত গল্পগুলোর কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। আলাউদ্দিন আল আজাদ গল্পের সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য এবং ভাষা-ব্যবহারে সচেতন শিল্পদৃষ্টির স্বাক্ষর রেখেছেন। ছোটগাল্পিক সংহতি, নাটকীয়তা এবং কাব্যিক ব্যঞ্জনা তাঁর ছোটগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সংগতি এবং ইঙ্গিতময়তায় ঋদ্ধ তাঁর গদ্যের এক উজ্জ্বল এলাকা -
কবিতার মতো গল্প-নির্মাণেও হাসান হাফিজুর রহমান রেখেছেন শৈল্পিক সিদ্ধির স্বাক্ষর। প্রগতিশীল সমাজচিন্তা হাসান হাফিজুর রহমানের শিল্পীমানসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যই তাঁর গল্পে এনেছে প্রাতিস্বিক মাত্রা। সামপ্রদায়িকতার যূপকাষ্ঠে মানুষের অরুন'দ পরিণতি তাঁর একাধিক গল্পে শিল্পরূপ লাভ করেছে। আরো দুটি মৃত্যু (১৯৭০) গল্পসংকলনের গল্পগুলো সামপ্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে মানবাত্মার গৌরবময় জাগরণ – আকাঙ্ক্ষার শৈল্পিক শব্দপ্রতিমা হিসেবে বিশিষ্টতার স্বাক্ষরবাহী। কবির সৃষ্টি হলেও এসব গল্প রোমান্টিক কাব্যময়তা থেকে সর্বাংশে মুক্ত। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবন-পর্যবেক্ষণ এবং প্রাগ্রসর সমাজের জন্য উজ্জ্বল আশাবাদই হাসান হাফিজুর রহমানের গল্পসাহিত্যের কেন্দ্রীয় ভাবপরিমণ্ডল। 'যে বস'বাদী বিশ্ববীক্ষা তাঁর কবিতার স্বাতন্ত্র্যের প্রাণবিন্দু, ছোটগল্পের শরীরে ও বক্তব্যে তার প্রথম অঙ্কুরোদ্‌গম।… সামপ্রদায়িক দাঙ্গা, মন্বন্তর, মহামারী, শ্রমজীবী মানুষের জীবনচিত্র, জীবনের দৈনন্দিনতা ও অন-র্লোক এবং সর্বোপরি মানুষের জাগতিক ও মানসিক দ্বন্দ্ববৈচিত্র্যকে গল্পের উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান।'৮ গল্পের প্রকরণ-প্রসাধনে হাসান হাফিজুর রহমান খুব যে সতর্ক ছিলেন এমন কথা বলা যাবে না, তবে তাঁর কোনো কোনো গল্প সাংকেতিকতা ও রূপকব্যঞ্জনায় অর্জন করেছে বিশিষ্টতা।
নাগরিক মধ্যবিত্তের স্বপ্ন, সংগ্রাম আর হৃদয়রহস্য নিয়ে গড়ে উঠেছে জহির রায়হানের গল্পভুবন। জহির রায়হানের সমাজসচেতন মানসতা এবং বস'তান্ত্রিক জীবনার্থের সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছে তাঁর ছোটগল্পে। মানবমনের গভীরতার রহস্যলোকে সন্ধানী আলো ফেলতে তিনি নিয়ত উৎসাহী শিল্পী। ভাষা-ব্যবহার এবং প্রকরণ-প্রসাধনে জহির রায়হান পরীক্ষাপ্রিয় কথাকার। তাঁর গল্প-আঙ্গিক চিত্রনাট্যধর্মী, সংহত এবং কবিতা্লিগ্ধ। তবে অতিনাটকীয়তার কারণে এবং উৎকণ্ঠার আধিক্যে কখনো কখনো তাঁর গল্প অর্জন করতে পারেনি শৈল্পিক সিদ্ধি। জীবনবোধের স্বাতন্ত্র্য দিয়ে, প্রকারণিক প্রাতিস্বিকতা দিয়ে বাংলাদেশের গল্পের ধারায় জহির রায়হান সংযোজন করেছেন একটি নূতন মাত্রা।
মনোগহনের জটিলতা ও অসংগতি উন্মোচনে বাংলাদেশের গল্পসাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হক অনতিক্রান- শিল্পী। প্রথম পর্বে সৈয়দ শামসুল হক বৃহত্তর জনজীবনের পটে গল্প লিখেছেন, কিন' দ্বিতীয় পর্বে মানবজীবনে অন-ঃঅসংগতি ও অন-র্বাস-বতার গল্পরূপ অঙ্কনেই হলেন অধিক উৎসাহী। 'তাঁর গল্পে জীবন ভিন্ন সুর পেয়েছে, গল্পে দেখা দিয়েছে প্রাণ। দেহের কাঠামো ছাড়িয়ে গল্পে প্রাণের সঞ্চার এবং শুধুমাত্র গল্পের জন্য গল্প এই ধারণা থেকে গল্পের মুক্তি,… তাঁর হাতেই প্রথম সার্থকভাবে ঘটেছে।'৯ নাগরিক মধ্যবিত্তের মনস-াত্ত্বিক জটিলতা, অসংগতি আর নির্বেদ অঙ্কনেই সৈয়দ শামসুল হকের মনোযোগ সমধিক। এর বাইরে জীবনের বৃহত্তর প্রাঙ্গণে তিনি ফেলতে চাননি কোনো সন্ধানী আলো। আমাদের সামাজিক অবস'ার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ নাগরিক জীবনচর্যা নিয়ে গল্প লিখতে গিয়ে, বোধ করি প্রায়শই তিনি কৃত্রিমতার দ্বারস' হয়েছেন। এসব গল্পের ভাবনা ও উপাদান আরোপিত, ফলে শিল্প-সার্থকতায় শীর্ষমুখ-অভিসারী হয়েও তা হঠাৎ-স্খলিত। 'আনন্দের মৃত্যু', 'পরাজয়ের পর', 'বন্ধুর সঙ্গে সন্ধ্যে', 'শেষ বাস' প্রভৃতি গল্পে এ-ধরনের কৃত্রিমতা সুস্পষ্ট।
সৈয়দ শামসুল হকের গদ্যরীতির প্রধান লক্ষ্য কাব্যময়তা। প্রতীক-উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারে তিনি পাশ্চাত্য রীতিপ্রভাবিত প্রাগ্রসর সাহিত্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন। বিষয়াংশ ও উপাদানের মতো, প্রকরণগত বৈশিষ্ট্যসমূহ, কোনো কোনো গল্পে, মনে হয় আরোপিত; বিষয় ও ভাবের প্রয়োজনে তা অনিবার্য নয়। তবে কোনো কোনো গল্পে, যেমন 'রক্তগোলাপে' তাঁর ভাষা বিষয়ানুগ, স্বচ্ছন্দ এবং গীতময়।
নাগরিক মধ্যবিত্ত-নিুবিত্ত জীবনের গল্প-অবয়ব সৃষ্টিতে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের অবদানও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বস্তুবাদী জীবনদৃষ্টির আলোয় মানব-মনস্তত্ত্বের জটিলতা উন্মোচনেই তিনি সমধিক আগ্রহী। 'সমাজসত্যের উপলব্ধিতে তিনি অনেকাংশে আল আজাদের সমগোত্রীয়; আজাদ যেখানে প্রত্যক্ষ ও উচ্চকণ্ঠ, বোরহানউদ্দিন সেখানে পরোক্ষ ও নির্লিপ্ত।'১০ ভাষা ও প্রকরণে স্বাতন্ত্র্য আনতে গিয়ে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রায়শই আড়ষ্টতা ও কৃত্রিমতার শিকার হয়েছেন, যা ক্ষুণ্ন করেছে তাঁর গল্পের শিল্পমূল্য। বোরহানউদ্দিনের ভাষা স্বাতন্ত্র্য-অভিলাষী, কিন' তা ছোটগল্পের জন্য একান-ই অনুপযোগী। প্রধানত শিল্পসাহিত্যিক ও গবেষক হলেও ছোটগল্প রচনায়ও আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। নগরজীবনের পটে তিনি উন্মোচন করেন মানব-অস্তিত্বের বহুমাত্রিক জটিলতা, মনস্তত্ত্ব-বিশ্লেষণে তিনি কুশলী শিল্পী। 'সম্রাজ্ঞীর নাম', 'চোর' প্রভৃতি গল্প এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয়। প্রহেলিকা ও অন্যান্য গল্প (১৯৫৯) গ্রনে' আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ মানবিক সম্ভাবনার জয়গাথা নির্মাণ করেছেন। তাঁর গল্পের ভাষা সরল ও বিষয়ানুগ, প্লট জটিলতামুক্ত ও সংহত।
পঞ্চাশের দশকের একজন খ্যাতিমান গল্পকার আনিস চৌধুরী। প্রধানত নাগরিক মধ্যবিত্ত-জীবন নিয়ে গল্প লিখেছেন আনিস চৌধুরী। মধ্যবিত্তের নানামাত্রিক মানস-বিকৃতি, অনন্বয়, অনি-মে মানবিক মূল্যচেতনায় জেগে ওঠে – এসব প্রসঙ্গ শিল্পিত হয়েছে তাঁর গল্পে। দূরসি'ত নিরাসক্ত দৃষ্টিতে পাত্র-পাত্রীদের বলোকন ও তাদের শব্দে চিত্রিত করা আনিস চৌধুরীর গল্পের বিশিষ্ট লক্ষণ। অনিস চৌধুরীর গল্পের আর এক উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য ব্যতিক্রমী সংলাপ নির্মাণ কৌশল। নাট্যরসাশ্রিত সংলাপ আনিস চৌধুরীর গল্পে সঞ্চার করেছে নাটকের ব্যঞ্জনা। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় তাঁর 'সুদর্শন ডাকছে', 'সেই অন্ধকার', 'প্রতীক্ষার এক বসন-', 'বৃষ্টি, রমনী ও একজন', 'আরেক রোববার', 'পরিব্রাজক' প্রভৃতি গল্প স্মরণ করা যায়।
পঞ্চাশের দশকের বাংলাদেশের ছোটগল্প-সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, বোধ করি এই যে, আমাদের ছোটগল্প এ-পর্বেই প্রথম হয়ে ওঠে মৃত্তিকামূলস্পর্শী ও জাতিসত্তার শিকড়-অন্বেষী। গল্পকাররা বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকরণ-পরিচর্যার প্রতিও ক্রমশ মনোযোগী হয়ে ওঠেন এ-কালখণ্ডে। বিষয়াংশ উপস্থাপনার অভিনবত্ব এবং নিরীক্ষাশীল ভাষারীতি দিয়ে এ-পর্বের শিল্পীরা সূচিত করে দেন ষাটের দশকে বাংলাদেশের ছোটগল্প-সাহিত্যের প্রকরণ-প্রসাধনের ঋদ্ধ পথযাত্রা।

চার
ষাটের দশকে বাংলাদেশের গল্প-সাহিত্যে সূচিত হয় একটি নতুন স্রোত। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কল্লোল আর সংক্ষোভের পটে রচিত এ-কালের গল্প প্রকৃত অর্থেই উদ্ভাসিত করেছে ষাটের উন্মাতাল বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের সংক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীকে। 'একদিকে সামরিক শাসনের পেষণ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপর্যয়, অবাঙ্গালী পুঁজির বিকাশ; অন্যদিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এই সময়কে অসি'র করে তোলে। এই সময়ে অগ্রজ গল্পকারেরা যখন গল্পের জগৎ থেকে এক প্রকার প্রস'ান করেছেন, তখন উঠে এসেছেন নতুন প্রজন্মের গল্পকারেরা।'১১
আলোচ্য পর্বে ছোটগাল্পিক-চৈতন্যে আমরা লক্ষ করি দুটি প্রবণতা। একদিকে রয়েছেন সেইসব শিল্পী, যাঁরা সামরিক শাসনের ভয়ে শঙ্কিত হয়ে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার প্রশ্নে আশ্রয় নিলেন বেতার-টেলিভিশন-বিএনআর-প্রেসট্রাস্টের নিরাপদ সৌধে। এঁদের রচনায় এলো পলায়নি মনোবৃত্তি, ফ্রয়েড-এলিস দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এঁরা নির্মাণ করলেন মৈথুন-সাধনার শব্দমালা। অপরদিকে আছেন সেইসব শিল্পী যাঁরা বিপর্যস্ত যুগ-পরিবেশে বাস করেও সমকালচঞ্চল জীবনাবেগ, যুগসংক্ষোভ এবং প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-দ্রোহ-বিদ্রোহ অঙ্গীকার করে গল্পের শরীরে জ্বেলে দিয়েছেন সমাজ-প্রগতির আলোকবর্তিকা। স্বৈরশাসনের শৃঙ্খলে বাস করেও এঁরা ছিলেন সত্যসন্ধানী, সংরক্ত সমকালস্পর্শী এবং প্রগতিশীল সমাজভাবনায় উচ্চকিত।১২ ষাটের দশকে যেসব গল্পশিল্পী বাংলাদেশের সাহিত্যে আবির্ভূত হন, তাঁদের শিল্পকর্ম বিশ্লেষণ করলেই আমাদের উপর্যুক্ত মন-ব্যের সত্যতা প্রমাণিত হবে। যেসব ছোটগাল্পিক সময়ের এ-পর্বে সাহিত্যসাধনায় ব্রতী হন, তাঁরা হচ্ছেন – নাজমুল আলম (১৯২৭-), সুচরিত চৌধুরী (১৯৩০-৯৪), মুর্তজা বশীর (১৯৩২-), সাইয়িদ আতীকুল্লাহ্‌ (১৯৩৩-৯৮), মাফরুহা চৌধুরী (১৯৩৪-), শহীদ আখন্দ (১৯৩৫-), হুমায়ুন কাদির (১৯৩৫-৭৭), শওকত আলী (১৯৩৬-), জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত (১৯৩৯-), হাসনাত আবদুল হাই (১৯৩৯-), রিজিয়া রহমান (১৯৩৬-), রাহাত খান (১৯৪০-), বুলবন ওসমান (১৯৪০-), মাহমুদুল হক (১৯৪০-), দিলারা হাশেম, রশীদ হায়দার (১৯৪১-), আবদুশ শাকুর (১৯৪১-), মাহবুব তালুকদার (১৯৪১-), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-৯৭), আহমদ ছফা (১৯৪৩-৯৯), আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-), সুব্রত বড়-য়া (১৯৪৫-), সেলিনা হোসেন (১৯৪৭-), কায়েস আহমদ (১৯৪৮-৯২) প্রমুখ। শৈল্পিক সিদ্ধি এবং জীবনার্থের প্রশ্নে এঁদের অনেকের মধ্যে রয়েছে মেরুদূর ব্যবধান; তবু আমরা তাঁদের একই পঙ্‌ক্তিতে বিন্যস- করছি – কেননা, এঁদের সকলেরই রয়েছে অভিন্ন কুললক্ষণ – এঁরা সকলেই দ্রোহ-বিদ্রোহ-সংক্ষোভ-সংগ্রামময় উত্তাল ষাটের গল্পকার।
নাজমুল আলম, সুচরিত চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, মাফরুহা চৌধুরী, হুমায়ুন কাদির, হাসনাত আবদুল হাই, রিজিয়া রহমান, বুলবন ওসমান, মাহবুব তালুকদার প্রমুখ শিল্পীর গল্পরচনাপ্রয়াস ষাটের দশকে শুরু হলেও এ-দশকের প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রকরণ-সতর্কতা এবং মনোগহন-বিশ্লেষণ এঁদের রচনায় অনুপস্থিত। নাগরিক মধ্যবিত্তের অতলযাত্রা আর অন-ঃসারশূন্যতা নিয়ে গল্প লিখেছেন নাজমুল আলম এবং সাইয়িদ আতীকুল্লাহ্‌। চট্টগ্রামের লোকায়ত জীবন এবং লোকগাথা-কিংবদন্তি নিয়ে সুচরিত চৌধুরী অনেক গল্প লিখেছেন, যা বাংলাদেশের গল্পের ধারায় সংযোজন করেছে একটি নতুন মাত্রা। মুর্তজা বশীর, রিজিয়া রহমান, আহমদ ছফা, বুলবন ওসমান এবং মাহবুব তালুকদারের গল্পে ধরা পড়েছে সমাজসচেতন মানস্তপ্রবণতা এবং সমাজপ্রগতির বাসনা। ইতিহাস-ঐতিহ্যের গল্প-অবয়ব সৃষ্টিতে রিজিয়া রহমান বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর 'অগ্নিস্বাক্ষরা' গল্পের কথা বলা যায়। তবে তাঁর গল্পে পরিলক্ষিত হয় উপকাহিনির আধিক্য, যা ছোটগল্পের শরীরে জড়ো করে উদ্বৃত্ত মেদ। মাফরুহা চৌধুরী নাগরিক মধ্যবিত্তের হার্দ্যজটিলতা উন্মোচনেই সমধিক আগ্রহী। হাস্যকৌতুক আর ব্যঙ্গের ধারায় বাংলাদেশের গল্পে শহীদ আখন্দ রেখেছেন বিশিষ্টতার স্বাক্ষর। ব্যঙ্গের আবরণে সুকৌশলে তিনি উন্মোচন করেন মানবজীবনের গভীরতর কোনো সত্য-উপলব্ধি। সরস-ব্যঙ্গ- কৌতুকের ধারায় আবদুশ শাকুরের সিদ্ধিও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। সামাজিক অসংগতি ও নাগরিক মধ্যবিত্তের বহুমাত্রিক জটিলতা উন্মোচনে আবদুশ শাকুর সরস-ব্যঙ্গ-কৌতুকের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। গ্রাম ও নগরের পটে নিুবিত্ত মানুষের দৈনন্দিনতা নিয়ে গল্প লিখেছেন হাসনাত আবদুল হাই। তাঁর গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য প্রকরণ-সতর্কতা। চিত্রলতা, আবেগী ভাষা এবং সংহত সংলাপ হাসনাত আবদুল হাইয়ের ছোটগল্পের জনপ্রিয়তার মৌল কারণ। হুমায়ুন কাদির, মাহমুদুল হক, দিলারা হাশেম প্রমুখ শিল্পীর রচনায় প্রাধান্য পেয়েছে আধুনিক মানুষের একাকিত্ববোধ, হার্দিক রক্তক্ষরণ এবং অতীত স্মৃতিমুগ্ধতা। নাগরিক মধ্যবিত্তের বিকৃতি, অসংগতি আর সদর্থক জীবনচেতনায় উত্তরণের ইতিকথা নিয়ে গড়ে উঠেছে বশীর আর হেলালের গল্পভুবন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে রচিত তাঁর গল্পের এক বিশাল এলাকাজুড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক স্মৃতি-অনুষঙ্গ।
বাংলাদেশের গল্প-সাহিত্যের ধারায় শওকত আলীর অবদান বিশিষ্ট ও ব্যতিক্রমধর্মচিহ্নিত। নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের বহুমাত্রিক অসংগতির চিত্র-অঙ্কনের ষাট-দশকী মৌল প্রবণতার পথ ছেড়ে গল্পে তিনি বিচরণ করেছেন গ্রামীণ জীবনতটে, গ্রামের নিরন্ন-নিঃস্ব খেটে-খাওয়া মানুষের যন্ত্রণা, সংগ্রাম ও দহনের পোড়োজমিতে। শওকত আলী শ্রেণিসচেতন শিল্পী, তাই বস'বাদী সমাজচিন্তার আলোকে তিনি তুলে ধরেন গ্রামীণ মহাজনশ্রেণির শোষণের চিত্র, নির্মাণ করেন সর্বহারা মানুষের সংগ্রাম ও উত্তরণের জয়গাথা। 'নবজাতক' গল্পে তাঁর সাহসী মানুষ মন্তাজ আলী মহাজন্তিশোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।
লেলিহান সাধ (১৯৭৩) কিংবা শুন হে লখিন্দর (১৯৮৬) সংকলনের কোনো কোনো গল্পেও উচ্চারিত হয়েছে এই প্রতিবাদ। সমালোচকের ভাষায় – 'লেলিহান সাধ' গল্পে মহাজনের ঘরে আগুন দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে সংগ্রামী মানুষের তীব্র প্রতিবাদ, কিংবা বৃদ্ধ সাঁওতাল কপিলদাসের বহুদিনের ভুলে যাওয়া তীর ছোড়ার অভ্যাস আবার রপ্ত করার মধ্যে রয়েছে শত্রু ঘায়েল করার প্রতীকী ব্যঞ্জনা। 'শুন হে লখিন্দর' গল্পে বঞ্চিত মানুষের নির্মম প্রতিশোধ-বাসনা মনসামঙ্গলের মিথে অতি চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন শওকত আলী।'১৩ তবে উন্মুল বাসনা (১৯৬৮) থেকেই লক্ষ করা গেছে, নর-নারীর যৌনপ্রবৃত্তি ও আদিমকামনা রূপায়ণে তিনি ক্রমশ হয়ে উঠেছেন উৎসাহী। এ-পথে পা বাড়িয়ে তিনিও আলাউদ্দিন আল আজাদের মতো বৃহত্তর লোকজীবনের প্রাঙ্গণ ছেড়ে আত্মকুণ্ডয়নে হয়েছেন নিমগ্ন। ফলে 'মন্তাজ আলী ও হাসান আলীর সঙ্কট, রহিম শেখের মৃত্যু, মহাজনদের হাতে জীবনকে নিঃশেষ করে দেওয়া – ইত্যাদি ছবিতে যে শওকত আলী কথা বলে ওঠেন, তার সাথে আজকের শওকত আলীর কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না – যেমন পাওয়া যায় না 'জেগে আছি'র আলাউদ্দিন আল আজাদকে 'যখন সৈকত' অথবা তার পরবর্তী গল্পগুলোতে।'১৪
বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার হাসান আজিজুল হক বাংলা ছোটগল্পের ধারায় সংযোজন করেছেন প্রাতিস্বিক মাত্রা। উত্তর-বাংলার গ্রামীণজীবন তাঁর গল্পের কেন্দ্রীয় শিল্প-উপাদান। বস'বাদী জীবনদৃষ্টির আলোয় তিনি উন্মোচন করেছেন সমাজজীবনের বহুমাত্রিক অবক্ষয়, শোষিত-ক্লিষ্ট মানুষের হাহাকার ও বঞ্চনা, কখনো-বা তাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কাহিনি। শাহরিক আত্মকেন্দ্রিক জীবনের নির্বেদ ও আপাত-আনন্দের উচ্ছ্বাস উপেক্ষা করে তিনি গ্রামীণ মেহনতি মানুষের সমষ্টিগত জীবন-অর্ণবে করেছেন অবগাহন – বাংলা গল্পের ধারায়, এভাবে তিনি নির্মাণ করছেন তাঁর আপন ভুবন, স'াপন করেছেন 'নিজস্ব এক উপনিবেশ'। বস'ত, হাসান আজিজুল হক হচ্ছেন সেই ব্যতিক্রমী গল্পকার, যাঁর বেশকিছু গল্প নির্দ্বিধায় সমগ্র বাংলা গল্পের আসরে প্রথম পঙ্‌ক্তিতে স'ান পাওয়ার যোগ্য। কখনো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কখনো জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, কী কমলকুমার মজমুদার, কখনো-বা ম্যাক্সিম গোর্কির প্রভাব পড়েছে হাসানের ওপর – তবু হাসান আজিজুল হক এইসব প্রভাববলয় অতিক্রম করে অবশেষে বাংলা গল্পধারায় স'াপন করেন মৌলিকতার শিল্পলোক। হাসান আজিজুল হকের প্রাতিস্বিকতা-নির্দেশে সমালোচকের মন-ব্য প্রণিধানযোগ্য -
হাসান আজিজুল হক জগদীশচন্দ্র গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোত্রজ গল্পকার। তিনি কোনো কোনো গল্পে – যেমন 'সারা দুপুর' বা 'সুখের সন্ধানে' – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর জগতে প্রবেশ করতে চেয়েছেন, আবার কখনো – যেমন 'জীবন ঘষে আগুন' নামক অসামান্য গল্পে তিনি বিস্ময়করভাবে, অথচ স্পষ্টতই কমলকুমার মজুমদারের, 'অন্তর্জলী যাত্রা'র কমলকুমারের ভাষারীতি ধার নিয়েছেন। এই সবই নিশ্চয় তন্ন তন্ন অনুসন্ধানের বিষয়, তবু জ্যোতিরিন্দ্র বা কমলকুমারের সঙ্গে এই লেখকের স্বভাবেই মিল নেই। তবু এই গল্পে বিশেষ করে কমলকুমারের অনুভূতি ও চিন-ার নিজস্ব মৌলিকতা ও বর্ণাঢ্যতা হাসান আজিজুল হকের মধ্যে সক্রিয় ছিল বলেই তিনি এই গল্পে কমলকুমারের ভাষার মডেল ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। অন্যত্র এ মডেল ব্যবহার করেননি। তিনি, যেমন আগেই বলেছি, জগদীশচন্দ্র ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোত্রজ। গোত্রজ, কিন' তিনি যা জেনেছেন, দেখেছেন, তাই দিয়ে এক বহুস্তর অভিজ্ঞতার জগৎ-ই শুধু তিনি রচনা করেননি, প্রেক্ষিতের স্বাতন্ত্র্যে গড়ে তুলেছেন এক নিজস্ব ভুবন; স'াপন করেছেন এক নিজস্ব উপনিবেশ।১৫
উত্তরবাংলার গ্রামীণ জনপদের ভাঙন, সামাজিক শোষণ, কখনো প্রতিবাদ, বাঁচার সংগ্রাম – এইসব কথা নিয়ে হাসানের গল্পজগৎ। তাঁর সব গল্পেরই মূলে আছে, বাঁচা জান-বভাবে বাঁচা, শিশ্নোদর-পরায়ণভাবে বাঁচা, স্থূলতম শারীরিকভাবে বাঁচা এবং সেই বাঁচার ন্যূনতম অসি-ত্বের নানান চেহারা, আর তার থেকে মুক্তির রূপও হরেকরকম। আর তা থেকে পরাজয়ের রূপও হরেকরকম। টিকে থাকার, বাঁচার, হেরে যাওযার বিস্বাদ, কটু, প্রায় নিয়তিবাদী উপলব্ধি, শিবনারায়ণ রায়ের ভাষায় 'নিরুচ্ছ্বাস আর্তি' নিয়ে১৬ গড়ে উঠেছে হাসানের ধ্রুপদী বিশাল গল্পভুবন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে তিনি লিখেছেন বেশকিছু সার্থক ছোটগল্প, যা প্রধানত গ্রথিত হয়েছে জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩) এবং নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫) গল্পসংকলনে। প্রধানত কৃষির সঙ্গে জড়িত গ্রামীণ মানুষের জীবন নিয়ে গল্প লিখেছেন হাসান। কিন্তু স্রষ্টার ব্যতিক্রমী জীবনার্থের স্পর্শে তাঁর গল্পগুলো হয়ে উঠেছে শাশ্বত মানবাত্মার প্রতিভূ। প্রথম পর্বের গল্পে তিনি যৌনতা এবং মানুষের আদিম কামনার শিল্পচিত্র নির্মাণে ছিলেন উৎসাহী। সামাজিক অবক্ষয় এবং মূল্যবোধের বিপর্যয় ধরতে তিনি ব্যক্তিমানুষের যৌনজীবনের পদস্খলনকেই তাঁর গল্পের শিল্প-উপাদান হিসেবে নির্বাচন করেছেন প্রাক্‌-সত্তর গল্প-পর্বে।১৭ কিন্তু ক্রমে তিনি অবগাহন করেছেন রাঢ়বাংলার বৃহত্তর জনজীবনসাগরে, এবং সেখান থেকে তুলে এনেছেন বেঁচে থাকার সঞ্জীবনী সুধা, দ্রোহ-বিদ্রোহ-প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সূর্যদীপ্র বাণী। ভাষা-প্রয়োগ এবং সংলাপ নির্মিতিতে হাসান আজিজুল হক পরীক্ষাপ্রিয় কথাশিল্পী। কখনো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কখনো-বা কমলকুমার মজুমদার তাঁকে প্রভাবিত করেছে প্রতিবেশ-নির্মাণ কিংবা বাক্যগঠন-প্রক্রিয়ায়। যেমন 'জীবন ঘষে আগুন' গল্প, যেখানে গদ্যরীতিতে পাই কমলকুমারের উত্তাপ -
রাজার হাতি এসে গেল। তার মেঘের মতো শরীর, তার স'ূলোদর, সেই মহাকায় পদ চতুষ্টয় নিয়ে হেলতে দুলতে মাঠের মাঝখানে দেখা দিল। সেখানে কোন বৃক্ষ ছিল না, কোনো বট বা অশত্থ – শুধু কিছু কাঁটা গাছ, পানসে ছায়া বাবলা, বড় জোর সেয়াকুল ধরনের গুল্ম এইসব মাঝে মাঝে। আর অনেক বড় লাল মাঠ – গরমের তড়াসে পীড়িত অসংখ্য গর্ত ইত্যাদি।
- ডিটেইলকে সংহত উপায়ে স্বল্পকথায় এখানে ধারণ করেছেন হাসান, যেমন করেন কমলকুমার। চিত্রল-পরিচর্যায় গল্প-প্রতিবেশ সৃষ্টিতে হাসান আজিজুল হকের সিদ্ধি শিখরবিন্দুস্পর্শী। তবে কখনো কখনো অতিকথন ('নামহীন গোত্রহীন'), কখনো-বা বর্ণনার বিস-ৃত আয়োজন ('জীবন ঘষে আগুন') ক্ষুণ্ন করেছে তাঁর ছোটগাল্পিক সিদ্ধিকে। প্রকৃতির চিত্র-অঙ্কনে তাঁর নৈপুণ্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। চরিত্রের অন-র্সত্তার অনুগামী হয়ে উঠে আসে হাসানের নিজস্ব প্রকৃতিলোক। তাই দেখি, সংগ্রামমুখর বঞ্চনাপীড়িত জীবনে তাঁর প্রকৃতি আসে রুক্ষতার আবরণে, বিবর্ণসত্তায় -
ষাটের উত্তালতা আর সংক্ষোভ আর নির্বেদের জগৎ থেকে গৃহীত হয়েছে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের গল্পসাহিত্যের মৌল-উপাদান। নাগরিক মধ্যবিত্তের বিচ্ছিন্নতা, রতিবিলাস ও অন-ঃসারশূন্যতার গল্প-অবয়ব নির্মাণেই তিনি অধিক আগ্রহী। মনস-াত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং আত্মকথনরীতির সাহায্যে তিনি উন্মোচন করেন চরিত্রের অন-র্লোক, কখনো-বা চেতনতলউদ্ভাসী টুকরো চিত্রকল্পের সাহায্যে তুলে ধরেন বিশেষ কোনো চরিত্রের অন-র্সত্তা। মগ্নচেতনাপ্রবাহের পথেও তিনি কখনো কখনো বিচরণ করেন মানব-অস্তিত্বের মৌলসংকট উন্মোচনে। সূচনা-পর্বে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত গল্প লিখেছেন গ্রামীণ নিুবিত্ত জীবন নিয়ে এবং এক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধি শীর্ষবিন্দু-অভিসারী। 'কেষ্টযাত্রা', 'রংবাজ ফেরে না' প্রভৃতি গল্প এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয়। 'কেষ্টযাত্রা', প্রকৃত অর্থেই, বাংলা ছোটগল্পের ধারায় এক উজ্জ্বল নির্মাণ। কিন্তু অনতিবিলম্বেই তিনি গ্রামীণ জীবন ছেড়ে নাগরিক মধ্যবিত্ত-আলয়ে সন্ধান করলেন তাঁর গল্প উপাদান। এবং এভাবে, আপন ক্ষেত্র থেকে বিচ্যুত হয়ে তিনি ক্রমশ হয়ে উঠলেন – বিষয় ও প্রকরণে – কৃত্রিম ও আড়ষ্ট। বহেনা সুবাতাস (১৯৬৭) এবং সীতাংশু, তোর সমস- কথা (১৯৬৯) গল্পগ্রন্থ থেকে দুটো অংশ উদ্ধৃত করলে উপর্যুক্ত বক্তব্য প্রমাণিত হবে।
ক. ভালো করে চোখ মেললে দেখা যায়, টেলিগ্রাফের তারে বসে দোর খাওয়া ল্যাজ ঝোলা পাখী, গৃহসে'র জীর্ণ কুটিরের প্রাঙ্গণে খড়ের মাড়াই, ঘরের পেছনে দাঁড়ানো কৌতূহলী কৃষক-রমণী অথবা অকস্মাৎ গাড়ী এসে পড়ায় বিব্রত, ডোবায় ্লানরতা পল্লীবালা সকলেই পরপর সকলেই আসছে এবং যাচ্ছে। ('লৌহবেষ্টনী')
খ. এই রকম ঘটে চলছে অনেক কাল। তবু শেষ আশ্রয় ছিলো বাসনা। রাত্রির কায়াহীন প্রশান্তিতে, শৈশবের কুয়াশায়, কৈশোরের বকুল তলে, যৌবনের দগ্ধভূমিতে বিচরণ করে কেবল মাত্র তারই কথা স্মরণ করে রক্তের স্পন্দনকে উৎসাহ দিয়েছি। ('ক্রীতদাসী বাসনা')
- প্রথম উদ্ধৃতিতে ভাষা ও বর্ণনার স্বতঃস্ফূর্ততায় ফুটে উঠেছে গ্রাম-প্রতিবেশের একটি মুগ্ধ ছবি; পক্ষান্তরে দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে ভাষা কষ্টকল্পিত, জটিলতা-আক্রান্ত – ফলে ছোটগাল্পিক ব্যঞ্জনাসৃষ্টিতে তা হয়ে পড়ছে অসমর্থ। তবে চতুর্থ গল্পগ্রন', পুনরুদ্ধারে (১৯৮৯) জ্যোতিপ্রকাশ আবার খুঁজে পেয়েছেন তাঁর স্বক্ষেত্র, বলা যায়, নিজেকেই তিনি পুনরুদ্ধার করেন পুনর্বার। উত্তরবাংলার জীবনপটে এখানে আবার তিনি ফিরে এসেছেন বৃহত্তর লোকালয়ে, তুলে ধরেছেন বাঙালির স্বপ্ন আর সংগ্রাম আর সম্ভাবনার কথা। 'মন্বন-র', 'বিচার চাই', 'সম্রাট', 'দিন ফুরানোর খেলা' প্রভৃতি গল্প এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।
প্রতীকীব্যঞ্জনা এবং চেতনাপ্রবাহরীতির পরিচর্যা জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ছোটগল্পের অন্যতম প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্য। সংহত স্বল্পবাক নির্মেদ সংলাপ-নির্মাণের গোপনমন্ত্র তাঁর করতলগত। আবেগ, কাব্যময়তা আর উদ্ভাসিত নাটকীয়তা থেকে জ্যোতিপ্রকাশের গল্প সর্বাংশে মুক্ত। গল্পের ফর্ম-নির্মাণে তিনি নিয়ত পরীক্ষাপ্রিয়। এইসব বৈশিষ্ট্য জ্যোতিপ্রকাশের গল্পকে এনে দিয়েছে বিশিষ্টতা; কেবল বাংলাদেশের সাহিত্যে নয়, সমগ্র বাংলা ছোটগল্পের পরিপ্রেক্ষিতেই এইকথা, বোধ করি, বলা সম্ভব।
নগরসভ্যতার অসংগতি আর বিকৃতি উন্মোচিত হয়েছে রাহাত খানের ছোটগল্পে। মধ্যবিত্ত জীবনই তাঁর গল্পের মৌল-উপাদান। নাগরিক মধ্যবিত্তের অসংগতি ও নির্বেদ তাঁর গল্পে উপসি'ত হয় যৌনতার প্রেক্ষাপটে, ফলে সেখানে প্রায়শই দেখা যায় আদিমকামনার খোলামেলা স'ূল চিত্র। ঢাকা শহরের অভিজ্ঞতালোক থেকেই রাহাত খান চয়ন করেছেন তাঁর গল্প-উপাদান। ফড়িয়া, দালাল, উঠতি ব্যবসায়ী, ধূর্ত রাজনীতিবিদ, বড়লোকের রক্ষিতা, আদর্শহীন থ্রিলার লেখক – এইসব চরিত্র বারবার ঘুরেফিরে আসে রাহাত খানের ছোটগল্পে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সামাজিক ভাঙন নিয়ে তিনি লিখেছেন কয়েকটি ভালো গল্প। রাহাত খানের ভাষা সাবলীল এবং কৃত্রিমতামুক্ত, ফলে পাঠকনন্দিত। ছোট ছোট বাক্য দিয়ে তিনি নির্মাণ করেন গল্পের ফুলেল শরীর।
নাগরিক মধ্যবিত্তের নির্বেদ-ব্যর্থতা-বিকৃতি-অসংগতির পটে গল্প লিখেছেন রশীদ হায়দার। মধ্যবিত্তের পরাভব নিয়ে গল্প লিখলেও, কাহিনির অনি-মে তিনি উপসি'ত করেন উত্তরণের ব্যঞ্জনাময় ইঙ্গিত। সমাজসচেতনতা রশীদ হায়দারের শিল্পীমানসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রগত সমাজচেতনার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর মানুষেরা; তাঁর গল্প আমাদের শোনায় মানবিক সম্ভাবনার জয়গাথা, সদর্থক চেতনায় উত্তরণের বিজয়মন্ত্র। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে রচিত তাঁর অনেক গল্পে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি-অনুষঙ্গ। অন-রে ভিন্ন পুরুষ (১৯৭৪), মেঘেদের ঘরবাড়ী (১৯৮২) প্রভৃতি গ্রনে' স্বাধীনতা-উত্তর ঢাকা শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত জীবনের সামূহিক অবক্ষয় পেয়েছে ভাষারূপ। রশীদ হায়দারের গল্পের ভাষা স্ফটিকসংহত, মেদমুক্ত এবং প্রতীকী-পরিচর্যাঋদ্ধ।
ষাটের দশকে আমাদের ছোটগল্পের অঙ্গনে যেসব প্রতিভাধর শিল্পী আবির্ভূত হয়েছেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁদের অন্যতম। পুরনো ঢাকার ক্ষয়িষ্ণুতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, স্বার্থপরতা আর জীবনসংগ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর গল্পের সমৃদ্ধভুবন। পুরনো ঢাকাকে ইলিয়াসের মতো এমন অনুপুঙ্খভাবে আর কেউ দেখেননি। তাঁর গল্পে কাহিনি অপেক্ষা চরিত্র-মনস-ত্ত্ব মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে, যা আধুনিক ছোটগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নেতি দিয়ে শুরু করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর চরিত্রকে সমাপ্তিতে পৌঁছে দেন ইতির রাজ্যে। ডিটেইলস তাঁর গল্পে উঠে আসে অবলীলায়। তবে কখনো কখনো এক গল্পের মধ্যে একাধিক উপগল্প পীড়িত করে মূল গল্পস্রোতকে। প্রায় তিরিশ বছরের সাহিত্যসাধনায় তিনি লিখেছেন মোট তেইশটি গল্প – এমনই স্বল্পপ্রজ এই শিল্পী। তবে হাতেগোনা এই গল্পগুলোর মধ্যেই ফুটে উঠেছে জীবনের বিচিত্র প্রান-, উপলব্ধির বহুবর্ণিল জগৎ। তাঁর অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬) গল্পগ্রনে' প্রকাশিত হয়েছে মানবিক সম্পর্কের আত্যনি-ক বিনষ্টি, খোঁয়ারিতে (১৯৮২) যুব-মানসের নির্বেদ; দুধভাতে উৎপাতে (১৯৮৩) নিরন্ন মানুষের জীবনে অমোঘ নিয়তিশাসন আর দোজখের ওম (১৯৮৯) গ্রনে' নেতি থেকে ইতিতে উত্তরণের কথকতা।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রকরণ-পরিচর্যায় নিরীক্ষাপ্রিয় শিল্পী। অ্যান্টি-রোমান্টিক দৃষ্টিকোণে প্রাত্যহিক ভাষায় তিনি নির্মাণ করেন যাপিত জীবনের চালচিত্র। পুরনো ঢাকার ভাষা, কুট্টিদের খিসি–খেউড়, আর বাখরখানি-সংস্কৃতি ইলিয়াসের গল্পে শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত যেন। তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন দীর্ঘ বাক্যগঠনে; 'এই দীর্ঘ বাক্যপাঠে অনভ্যস- পাঠকের কাছে তাঁর গদ্য বিরক্তিকর হলেও সজ্ঞান হৃদয়সংবাদী পাঠক গল্পের ভেতরে প্রবেশে বাধাগ্রস- হন না।'১৮ ফ্ল্যাশ-ব্যাক পদ্ধতিতে কাহিনিবয়ন ইলিয়াসের ছোটগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ষাটের গল্পকারদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ সবচেয়ে বেশি প্রাতিস্বিকতাবিলাসী শিল্পী। আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার গল্পভাষ্য নির্মাণে তিনি সিদ্ধহস-। বিষয়াংশ এবং প্রকরণের অভিনবত্বে তাঁর গল্পসাহিত্য বিশিষ্টতার দাবিদার। তবে, প্রথম পর্বের গল্পে, কনটেন্ট ও ফর্মে, আরোপিত উপাদান গল্পের মূলস্রোতের সঙ্গে জৈবসমগ্রতায় একাত্ম হতে পারেনি। বিচ্ছিন্নতা ও নির্বেদের যন্ত্রণায় তাঁর অধিকাংশ নায়ক পীড়িত ও পর্যুদস-। প্রতীকী এবং পরাবাস-ববাদী পরিচর্যা আবদুল মান্নান সৈয়দের ছোটগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রথম পর্বের গল্পের ভাষারীতিতে আরোপিত আধুনিকতা দ্বিতীয় পর্বে পরিত্যক্ত হয়েছে; ফলে, গল্পস্রোত হয়েছে অনেক বেশি সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ।
আধুনিক নাগরিক মধ্যবিত্তের অনন্বয় আর অসংগতি আর হার্দ্য-জটিলতা নিয়ে গল্প লিখেছেন সুব্রত বড়-য়া। মগ্নচৈতন্যের জটিল বঙ্কিম পথে তিনি উন্মোচন করেন মানব-অসি-ত্বের স-রীভূত সংকট – অবনীশ বড়-য়া, মনীষা রায় আর শুক্লাদির হৃদয়ের যতো গোপন যন্ত্রণা। বিষয়াংশ এবং প্রকরণ – পরিচর্যার বিচারে একজন আধুনিক ছোটগাল্পিক হিসেবে তাঁকে চিনে নেওয়া যায় সহজেই। বাক্যগঠনে তিনি পরীক্ষাপ্রিয়, শব্দ-ব্যবহারে সতর্ক। কখনো কখনো চূর্ণ চিত্রকল্প কী অসামান্য কোনো উপমা তাঁর গল্পের পরিণামী ব্যঞ্জনাকে করে তোলে সংহত সুগভীর।
নগর আর গ্রাম – উভয় প্রাঙ্গণেই গল্পকার সেলিনা হোসেনের অনায়াস যাতায়াত। নিুবিত্ত খেটে-খাওয়া মানুষের যাপিত জীবনের নানা সমস্যা নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর গল্পের ধ্রুপদী জগৎ। জীবনের আহ্বানে, বেঁচে থাকার আকুল বাসনায় তাঁর প্রিয় মানুষেরা গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে শহরে। কিন' গ্রামের মতো শহরেও এরা অপাঙ্‌ক্তেয়, অবশেষে উন্মূলিত, জীবনবিচ্যুত, আশারিক্ত। উৎস থেকে নিরন- (১৯৬৯), খোল-করতাল (১৯৮২) প্রভৃতি গ্রনে' এইসব উন্মূলিত-নিরন্ন-আশাহত মানুষের সাক্ষাৎ পাই আমরা। ইতিহাস-ঐতিহ্যের পটে চরিত্রনির্মাণ সেলিনা হোসেনের অন্যতম ছোটগাল্পিক বৈশিষ্ট্য। মানব প্রগতির স্বার্থেই তিনি বিচরণ করেন ঐতিহ্যলোকে, কখনো-বা ইতিহাস, কখনো-বা সংক্ষোভময় সমকালে। সমাজসচেতনতা এবং বস'বাদী জীবনপ্রত্যয় নিয়ে তারা উত্তীর্ণ হয় জ্যোতির্ময় পরমার্থলোকে। এই ইতিবাচক জীবনদৃষ্টি বাংলাদেশের সাহিত্যে সেলিনা হোসেনের প্রাতিস্বিকতার কেন্দ্রীয় উৎস। তিনি বিশ্বাস করেন -
আজকের দিনে তৃতীয় বিশ্বের লেখকদের শেকড়সন্ধানী অনুপ্রেরণা বৈরী সময়কে অতিক্রম করতে চায়, অতিক্রম করতে চায় মিলিটারি অ্যারিস্টোক্রেসির বদৌলতে বন্দুকের শাসন। কেননা এই শাসন-উদ্ভূত পরিসি'তি সৃষ্টি করে মূল্যবোধের অবক্ষয়। যে অবক্ষয় সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে ঢুকিয়ে রাখে কালো থাবা। যার নিষ্পেষণে পদদলিত হয় সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা। এই আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রমূর্ত রাখার দায়-দায়িত্ব লেখকের।১৯
- এই বিশ্বাসে দৃঢ়মূল থেকেই তিনি নির্মাণ করেন তাঁর উপন্যাস, তাঁর ছোটগল্প। বিষয়াংশের মতো প্রকরণ-পরিচর্যায়ও সেলিনা হোসেন পরীক্ষাপ্রিয় ও স্বাতন্ত্র্য-অন্বেষী। গল্পে অপ্রচলিত এবং আঞ্চলিক ভাষা-ব্যবহারে তাঁর নৈপুণ্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর গল্পের ভাষা গীতল ও চরিত্রানুগ, প্লট সংহত, আর সংলাপ কেন্দ্র-অভিমুখী।
আশির দশকে প্রথম গল্পসংকলন প্রকাশিত হলেও গল্পকার হিসেবে কায়েস আহমেদের আবির্ভাব ষাটের দশকে। 'কালের দায়, কালোত্তীর্ণের দায়, শিল্পের দায় সব কিছুই বস'তঃ সমাজেরই দায়, মানুষেরই দায়।'২০ – এই বিশ্বাসে সি'ত থেকে তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস'ার বহুমাত্রিক সংকটের পটে মানব-অসি-ত্বের সামগ্রিক রূপ-অঙ্কনই তাঁর ছোটগাল্পিক অভিযাত্রার মৌল-অন্বিষ্ট। এ প্রসঙ্গে তাঁর 'অপূর্ণ তুমি ব্যর্থ বিশ্ব', 'ফেরারী বসন-কে খুঁজে', 'লাশ কাটা ঘর' প্রভৃতি গল্পের নাম স্মরণীয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নকশাল-আন্দোলনের পটভূমিকায় লেখা 'মহাকালের ঘোড়া', 'দুই গায়কের গল্প', 'নিয়ামত আলীর জাগরণ' প্রভৃতি গল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের কোনো গল্পকারই পশ্চিমবঙ্গের নকশাল-আন্দোলনের ব্যর্থতা ও অন-ঃসারশূন্যতাকে এমন সূক্ষ্মতর পর্যবেক্ষণে উপস'াপন করতে সমর্থ হননি। রাঢ়বাংলা ও সমতট অঞ্চলের বিস-ীর্ণ জীবনপটে বিন্যস- হয়েছে তার ছোটগাল্পিক ক্যানভাস। তিনি ছোটগল্পে বেছে নেন সেইসব চরিত্র – শ্রমে-ঘামে, আনন্দে-বিষাদে, সাফল্যে-ব্যর্থতায়, স্বপ্নে-সাধে যাদের জীবন স্পন্দিত-সংক্ষুব্ধ-কল্লোলিত। বিষয়াংশ ও শৈলী-সৌকর্যে কায়েস আহমেদের গল্প সমগ্র বাংলা গল্পের ধারাতেই দাবি করতে পারে স্বতন্ত্র মর্যাদা। কায়েস আহমেদের ভাষা গদ্য-পদ্যের যুগলবন্দিতে বিশিষ্ট ও ব্যতিক্রমী। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভাষাশৈলী ও চৈতন্যগ্রন্থির সঙ্গে কায়েস আহমেদের শিল্পরীতির সার্ধম্য কখনো কখনো আমরা অনুভব করি। তবে জীবন-উপলব্ধিতে মৌলিকভাবেই তিনি শীর্ষেন্দু থেকে দূরবর্তী জগতের বাসিন্দা। পরাবাস্তব আর মগ্নচেতনার প্রভাবে তাঁর গদ্য প্রগত ও প্রাতিস্বিক। যেমন -
বিকেলের মরে যাওয়া হলদে আলোটা এতোক্ষণ খেলা করছিলো নোটন পায়রার মতো, এক সময় জানলা গলে উড়ে গেছে। অন্ধকার এখন বেড়ালের মতো ঘরের ভেতর হেঁটে বেড়াচ্ছে নিঃশব্দ পায়ে। ('অপূর্ণ তুমি ব্যর্থ বিশ্ব')
আলোচ্য পর্বে রচিত বাংলাদেশের ছোটগল্পসাহিত্য গ্রামজীবন অতিক্রম করে ক্রমশ শহরমুখী হয়ে উঠেছে। তুলনাসূত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমাদের ছোটগাল্পিকরা গ্রামীণ জীবন চিত্রণে যতোটা স্বচ্ছন্দ, বস'নিষ্ঠ, নগরজীবন চিত্রণে ততোটা নন। তিরিশের পশ্চিমবঙ্গীয় কথাসাহিত্যের প্রভাবে এ-পর্বে নবীন ছোটগাল্পিকদের রচনায় এসেছে আধুনিক নাগরিকচেতনা, লিবিডোতাড়িত মনোবিকলন এবং যুদ্ধোত্তর পশ্চিমি অবক্ষয়ীচেতনা। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনে অবরুদ্ধ সংক্ষুব্ধ পূর্ববাংলার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটও এ সময়ের ছোটগল্পে অভিব্যঞ্জিত হয়েছে। পাকিস্তানোত্তর প্রথম দশকের তুলনায় এ পর্বের ছোটগাল্পিকরা অনেক বেশি আঙ্গিকসচেতন ও প্রকরণনিষ্ঠ; বিষয়াংশ-নির্বাচন, ভাষা-ব্যবহার এবং প্রকরণ-পরিচর্যায় অধিকাংশ ছোটগাল্পিক পরীক্ষাপ্রবণ ও বৈচিত্র্যসন্ধানী। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তীকালের এই উত্তরাধিকারের ওপরও নির্মিত হয়েছে বিদেশি শত্রুমুক্ত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ছোটগল্প-সাহিত্য।

পাঁচ
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনে সূচিত হলো মৌল পরিবর্তন, চেতনার ক্ষেত্রেও ঘটলো গুণগত বিকাশ। সমাজ জীবনের অন-র্গঠনের রূপ-পরিবর্তন অভ্যন-র নিয়মেই রূপান-রিত করে সমাজের বহির্গঠন তথা চৈতন্যপ্রবাহ। এজন্যেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি দেশের স্বাধীনতা সমগ্র জাতিকে রূপান্তরিত সত্তায় করে পুনর্জাত। স্বাধীনতার সোনালি প্রভায় আমাদের মন আর মননের যে নতুন চেতনা জাগ্রত হয়েছে, ছোটগল্পে তার প্রতিফলন ছিল একান-ই প্রত্যাশিত। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ ছোটগাল্পিক যুদ্ধোত্তর জাতীয় হতাশা এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শব্দচিত্র অঙ্কনেই হলেন অধিক আগ্রহী; দ্রোহ-বিদ্রোহ-প্রতিবাদে উচ্চকিত হওয়ার পরিবর্তে অনেকেই যেতে চাইলেন নির্বেদ-নিরানন্দের অতল গহ্বরে; এবং সবাই মিলে সম্মিলিত-সাধনায় লিখলেন মাত্র একটি ছোটগল্প, যার মৌল বিষয় নাস্তি – নিখিল নাসি-। তবে একই সঙ্গে এ-কথা অনস্বীকার্য যে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ছোটগল্পে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম ও বিজয়ের বিমিশ্র অভিব্যক্তি, যা একান্তই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার। যুদ্ধোত্তর সময়ে সর্বব্যাপী হতাশা, নির্বেদ ও বিপর্যয় কাটিয়ে মহৎ শিল্পীমানস অনুসন্ধান করে জীবন ও শিল্পের জন্যে সদর্থক এবং আলোকোজ্জ্বল এক মানসভূমি – কোনো কোনো ছোটগাল্পিকের রচনায় এ জাতীয় অভিজ্ঞান মুক্তিযুদ্ধোত্তর ছোটগল্প-সাহিত্যের আশাব্যঞ্জক দিক। স্বাধীনতা-উত্তরকালে যে-সব গল্পকার বাংলাদেশের সাহিত্যে আবির্ভূত হন, তাঁরা হচ্ছেন – মালিহা খাতুন (১৯২৮-), হেলেনা খান (১৯২৯-), কাজী ফজলুর রহমান (১৯৩১-), আবুবকর সিদ্দিক (১৯৩৪-), আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দীন (১৯৩৪-), রাবেয়া খাতুন (১৯৩৫-), রাবেয়া সিরাজ (১৯৩৫-), খালেদা সালাউদ্দিন (১৯৩৫-), মকবুলা মনজুর (১৯৩৮-), আল মাহমুদ (১৯৩৮-), খালেদা এদিব চৌধুরী (১৯৩৯-২০০৮), নাজমা জেসমীন চৌধুরী (১৯৪০-১৯৮৯), নয়ন রহমান (১৯৪০-), জুবাইদা গুলশান আরা (১৯৪২-), আমজাদ হোসেন (১৯৪২-), আবু কায়সার (১৯৪৫-), হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-), আবুল হাসান (১৯৪৭-৭৫), শহিদুর রহমান, জুলফিকার মতিন, আরেফিন বাদল, বুলবুল চৌধুরী, শান-নু কায়সার, আফসান চৌধুরী, তাপস মজুমদার, সৈয়দ ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, আতা সরকার, আবু সাঈদ জুবেরী, মঞ্জু সরকার, হরিপদ দত্ত, শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন, আহমদ বশীর, মুস-াফা পান্না, সিরাজুল ইসলাম, জাফর তালুকদার, সেলিম রেজা, কাজী শামীম, মঈনুল আহসান সাবের, ইসহাক খান, এহসান চৌধুরী, সাইয়িদ মনোয়ার, ইমরান নূর, সারোয়ার কবীর, রেজোয়ান সিদ্দিকী, সুশান- মজুমদার, সুকান- চট্টোপাধ্যায়, হারুন হাবীব, ভাস্কর চৌধুরী, বিপ্লব দাশ, ইসমাইল হোসেন, শাহ্‌নাজ মুন্নী, মহীবুল আজিজ, পারভেজ হোসেন, নকীব ফিরোজ, রায়হান রাইন, মনি হায়দার, লুৎফর রহমান রিটন প্রমুখ শিল্পী।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে অমিত সম্ভাবনা নিয়ে উন্মোচিত হয়েছেন পূরবী বসু। নারী জীবনের অস্তিত্ব এবং নারীত্বের মর্মবেদনা তাঁর গল্পের প্রধান বিষয়। তাঁর বলার ঢং আলাদা। নারীর অন-র্দাহ তাঁর মতো করে আর কোনো গল্পকার উন্মোচিত করেননি।
এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ ও উপাদানপুঞ্জ ব্যবহার করে ছোটগল্প রচনায় বাংলাদেশের নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের মাঝে দেখা দেয় ব্যাপক উৎসাহ। আমাদের গল্পকারদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ছিলেন জড়িত। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা যুদ্ধোত্তর কালে তাঁদের কাছে বিপুল অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দেখা দেয়। দীর্ঘ সিকি শতাব্দী ধরে নিজেকে শনাক্ত করার যে-সাধনায় বাংলাদেশের শিল্পীরা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, তার সাফল্যে ছোটগল্পের ভাব-ভাষা-প্রকরণশৈলীতে যুদ্ধোত্তর কালে এসেছে নতুন মাত্রা। বিষয় ও ভাবের দিক থেকে বাংলাদেশের ছোটগল্পে যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে; তেমনি ভাষা-ব্যবহার এবং অলঙ্কার-সৃজনেও মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ উপসি'ত। ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্নভাবে। কখনো সরাসরি যুদ্ধকে অবলম্বন করে ছোটগল্প রচিত হয়েছে, কখনো-বা ছোটগল্পের মৌল-ভাব সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে। কোনো কোনো ছোটগল্পে স্বাধীনতার স্বপক্ষীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং বিপক্ষীয়দের প্রতি ঘৃণাবোধ উচ্চারিত হয়েছে। আবার কোথাও-বা ছোটগল্পের বহিরঙ্গে লেগেছে মুক্তিযুদ্ধের স্পর্শ। মুক্তিযুদ্ধের উপাদানপুঞ্জ ব্যবহার করে বাংলাদেশের প্রায় সব গল্পকারই রচনা করেছেন ছোটগল্প। শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে যাঁদের গ্রন' প্রকাশিত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন – বশীর আল হেলাল প্রথম কৃষ্ণচূড়া (১৯৭২), হাসান আজিজুল হক নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), সৈয়দ শামসুল হক জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০), বিপ্রদাস বড়-য়া যুদ্ধজয়ের গল্প (১৯৯১), কাজী ফজলুর রহমান ষোলই ডিসেম্বর ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৮৮), সৈয়দ ইকবাল একদিন বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য গল্প (১৯৮৬), এহসান চৌধুরী একাত্তরের গল্প (১৯৮৬), শওকত ওসমান জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৭৫), আলাউদ্দিন আল আজাদ আমার রক্ত, স্বপ্ন আমার (১৯৭৫), আবু জাফর শামসুদ্দীন রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা (১৯৭৭), আবুবকর সিদ্দিক মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৭৭), সাদেকা শফিউল্লাহ যুদ্ধ অবশেষে (১৯৮০), খালেদা সালাহউদ্দিন যখন রুদ্ধশ্বাস (১৯৮৬) প্রমুখ। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গে যেসব গল্পের কথা বিশেষভাবে স্মরণীয়, লেখকনামসহ তার তালিকাটি এরকম – সত্যেন সেন 'পরিবানুর কাহিনী', তাজুল ইসলাম ফিরোজ 'সপ্তর্ষী অনেক দূরে', মঞ্জু সরকার 'শানি- বর্ষিত হোক', শওকত আলী 'সোজা রাস-া', 'আকাল দর্শন', আফসান চৌধুরী 'ফাঁকা শহরের গল্প', সিরাজুল ইসলাম 'দূরের খেলা', রাহাত খান 'মধ্যিখানের চর', রশীদ হায়দার 'কল্যাণপুর, এ কোন ঠিকানা', মীর নূরুল ইসলাম 'স্বৈরিণী ফিরে এসো', কায়েস আহমেদ 'আসন্ন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অপঘাত', সেলিম হোসেন 'আমিনা ও মদিনার গল্প', মাহমুদুল হক 'কালো মাফলার', মঈনুল আহসান সাবের 'কবেজ লেঠেল, ভুল বিকাশ', সুচরিত চৌধুরী 'নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত', আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী 'কেয়া, আমি এবং জারমান মেজর', জহির রায়হান 'সময়ের প্রয়োজনে', শামসুদ্দীন আবুল কালাম 'পুঁই ডালিমের কাব্য', আমজাদ হোসেন 'উজানে ফেরা', হুমায়ূন আহমেদ 'শীত', 'উনিশ' শ একাত্তর', রিজিয়া রহমান 'ইজ্জত', হুমায়ুন আজাদ 'যাদুকরের মৃত্যু', মামুন হুসাইন 'মৃত খড় ও বাঙাল একজন' প্রভৃতি। মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ-উপাদান নিয়ে রচিত হয়েছে এসব গল্প। মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সঙ্কলন-গ্রনে'র কথাও এখানে স্মরণীয় – আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী-সম্পাদিত বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭১), আবুল হাসনাত-সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৮৩), হারুন হাবীব-সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প (১৯৮৫), বিপ্রদাশ বড়-য়া-সম্পাদিত মুক্তিযোদ্ধার গল্প (১৯৯১) প্রভৃতি। এসব গ্রনে' অন-র্ভুক্ত গল্পসমূহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা ও অনুষঙ্গ শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় হয়েছে উদ্ভাসিত।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনেক গল্প রচিত হলেও আমরা এখনো পাইনি এমন একগুচ্ছ কালজয়ী গল্প, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির সম্মিলিত চৈতন্যের জাগরণকে যথাযথভাবে প্রতিমায়িত করতে সমর্থ হয়েছে। এর কারণ বহুবিধ। প্রথমত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বল্পস'ায়িত্ব এটিকে যথার্থ জনযুদ্ধে পরিণত হতে দেয়নি, ফলে মুক্তিযুুদ্ধের চেতনাও হয়নি সর্বব্যাপ্ত এবং এরই শিকার, অধিকাংশ বাঙালির মতো, বাংলাদেশের ছোটগাল্পিকরাও। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধ এখনো অত্যন- কাছের একটি ঘটনা, এবং এজন্যই অধিকাংশ ছোটগাল্পিকের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা – আবেগ-উচ্ছ্বাসতাড়িত, সেখানে স্বভাবতই ফুটে ওঠে শৈল্পিক নিরাসক্তির অভাব। সময় পেরিয়ে যখন আসবে নতুন প্রজন্মের ছোটগাল্পিক, হয়তো তাঁদের হাতেই লেখা হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা একগুচ্ছ কালোত্তীর্ণ ছোটগল্প।
স্বাধীনতা-উত্তর ছোটগল্পে আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেকটা কমেছে, তুলনামূলকভাবে বেড়েছে বিষয়ের বৈচিত্র্য। এ পর্বে অধিকাংশ ছোটগাল্পিক যুদ্ধোত্তর হতাশা-অবক্ষয় আর নৈরাজ্যের শব্দরূপ নির্মাণে সচেষ্ট হলেন; উৎসাহী হলেন যন্ত্রণাদগ্ধ তারুণ্যের নষ্ট-জীবনের শিল্পমূর্তি-সৃজনে। সত্তরের দশকের বাংলাদেশের ছোটগল্পের মৌল-প্রবণতা ওই দশকেরই একজন প্রধান গল্পকারের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে এভাবে -
সত্তরের গল্পকাররা প্রত্যেকে বয়সে নবীন। কিন' সমাজ, মানুষ, পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে গল্প রচনায় নবীন নন। স্বাধীনতা-পরবর্তী ঘটনার প্রতি রয়েছে তাঁদের তীব্র চাউনি। যুদ্ধোত্তর সংকটে, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, '৭৪-এর দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, সামরিক অভ্যুত্থান এবং শাসক শ্রেণীর প্রতারণার বাস-বতা সত্তরের গল্পকারদের জীবন- বিষয়। লেখকদের মধ্যে যাঁরা সমাজ সজ্ঞান তাঁরা বুর্জোয়া রাজনীতির সীমাবদ্ধতা ও স্খলন ছোটগল্পে চিত্রিত করেন। সত্তরের রোমান্টিক ধারার গল্প লেখকরাও সামাজিক অসাম্য অসি'রতা চিত্রিত করেছেন তাঁদের গল্পে।… এই দশকে গল্পলেখকদের গল্প-পাঠে দেখা যায়, তাঁরা যে যে অবস'ার মুখোমুখি হয়েছেন তার সব কিছু আত্মসাৎ করেছেন ছোটগল্পে। গ্রাম শহর উভয়বিধ পটভূমি উঠে এসেছে ছোটগল্পের জমিতে।২১
স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের ছোটগল্পে যেসব শিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছে, তাঁদের মধ্যে বুলবুল চৌধুরী, হুমায়ূন আহমেদ, আল মাহমুদ, আবুবকর সিদ্দিক, আতা সরকার, আহমদ বশীর, মঞ্জু সরকার, পূরবী বসু, সৈয়দ ইকবাল, হরিপদ দত্ত, শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন, সুশান- মজুমদার, সুকান- চট্টোপাধ্যায়, মুস-াফা পান্না, মঈনুল আহসান সাবের, জাকির তালুকদার, আহমাদ মোস-ফা কামাল, প্রশান- মৃধা, শাহ্‌নাজ মুন্নী, মহীবুল আজিজ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, রায়হান রাইন প্রমুখ শিল্পী প্রকৃত অর্থেই রেখেছেন প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষর।
হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্তের জীবন-চিত্রণে সিদ্ধহস-। মধ্যবিত্তের তরুণদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম ও স্বপ্ন তাঁর গল্পের উপজীব্য। 'চোখ' তাঁর অসামান্য একটি গল্প। তাঁর কৃতিত্ব শিখরস্পর্শী এবং তাঁর গল্পে মানব জীবনের হৃদয়-যন্ত্রণা ভিন্ন মর্যাদা পায়।
সাবলীল গদ্যে মানুষ ও সমাজের তলদেশ উদ্ভাসনে বুলবুল চৌধুরীর নৈপুণ্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। মানুষের আদিম জৈবকামনার নিরাভরণ চিত্র প্রতীকী ব্যঞ্জনা এবং আবেগী পরিচর্যায় অঙ্কিত হয়েছে আল মাহমুদের ছোটগল্পে। 'পানকৌড়ির রক্ত' কিংবা 'জলবেশ্যা'র মতো দুঃসাহসী গল্পে কাম-বাসনার পটে মানব-মনস্তত্ত্বের জটিলতা উন্মোচনে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন আল মাহমুদ।
সুশান- মজুমদার মুক্তিযুদ্ধোত্তর নৈরাশ্য, সামাজিক অসঙ্গতি, সামপ্রদায়িক শক্তির অত্যাচার এবং নিুবিত্ত মানুষের জীবনসংগ্রাম ও অসি-ত্ব সংকট নিয়ে গল্প লিখেছেন। মঞ্জু সরকারের গল্পে ফুটে উঠেছে মহাপীড়িত উত্তরবঙ্গের দারিদ্র্যলাঞ্ছিত মানুষের জীবনসংগ্রামের ছবি। হরিপদ দত্তের গল্পে পাওয়া যায় শ্রেণিসংগ্রাম চেতনা ও সাম্যবাদী আদর্শের শিল্পায়ন। সুশান-, মঞ্জু, হরিপদের গল্প রাজনৈতিক চেতনাঋদ্ধ এবং প্রগতিশীল সমাজদৃষ্টি-লালিত। ইমদাদুল হক মিলনের গল্পেও পাওয়া যায় ইতিহাস ও রাজনীতির যুগল অঙ্গীকারের চিত্র। নাসরীন জাহান নারীবাদী দৃষ্টিকোণে গল্প লিখে বাংলাদেশের ছোটগল্পের ধারায় নতুন এক মাত্রা সঞ্চার করেছেন। নারী-মনস-ত্ত্ব নির্মাণে তার নিপুণতা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। বর্ণনাপ্রধান গল্প নিযে সিদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন মঈনুল আহসান সাবের, আহমদ বশীর, মহীবুল আজিজু প্রমুখ ছোটগাল্পিক। আক্রিক-পরীক্ষা এবং মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যায় মামুন হোসাইনের গল্প অর্জন করেছে বিশিষ্টতা।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে যুগসংকট এবং রাজনৈতিক সংক্ষোভ ও সংগ্রাম নিয়ে গল্প লিখছেন আবুবকর সিদ্দিক। বিষয় ও প্রকরণে তাঁর গল্প বিশিষ্ট ও স্বাতন্ত্র্য প্রত্যাশী। রাজনৈতিক অনুষঙ্গ নিয়ে গল্প-রচনায় সৈয়দ ইকবালও সমধিক উৎসাহী। স্বাধীনতা-উত্তরকালের বিপন্নতা ও নির্বেদ নিয়ে বেশ কিছু নিরীক্ষাসফল গল্প লিখেছেন তিনি। সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে জীবন ও প্রকৃতির মনোময় একাত্মতা বাংলাদেশের ছোটগল্পে সংযোজন করেছে নতুন মাত্রা। এ-প্রসঙ্গে তাঁর 'ভগবান', 'জটাধারীর বান্নী', 'উজানিভাটালি' প্রভৃতি গল্প বিশেষভাবে স্মরণীয়। রাজনৈতিক কূট-তর্ক, তত্ত্বসংকট এবং সামরিক শাসনের পটে গল্প লিখেছেন আতা সরকার। সত্তুর দশকের রাজনীতি যেন বন্দি হয়ে আছে আতা সরকারের গল্পে।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো আহমদ বশীরও ঢাকার জনজীবন নিয়ে গল্প লিখে বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। মঞ্জু সরকারের গল্পে রূপান্বিত হয়েছে উত্তরবাংলার রুক্ষ প্রকৃতি, বিধ্বস্ত জনপদ, বিপন্ন সমাজ আর সংগ্রামী জনগোষ্ঠী। রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয়ও ফুটে আছে মঞ্জু সরকারের গল্পে।
শ্রেণিসচেতন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে শোষকের পতন আর শোষিতের উত্থান নিয়ে গল্প লিখেছেন হরিপদ দত্ত। খেটে-খাওয়া নিপীড়িত মানুষের প্রতিবাদী চেতনাই তাঁর গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয়। চড়া সুর বাঁধা হরিপদ দত্তের গল্প। চলিত ও আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগে হরিপদ দত্তের সাফল্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুস্তফা পান্নার গল্পেও আছে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের শৈল্পিক সিদ্ধির স্বাক্ষর। দক্ষিণবাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠী আর তাদের সংগ্রামশীল জীবনই মুস্তফা পান্নার গল্পের মৌল বিষয়। হরিপদ দত্তের মতো মুস্তফা পান্নার গল্পে অন্তর্স্রোতেও সর্বদা বহমান শ্রেণিচেতনা। মানবমনের অন্তগূর্ঢ় রহস্য-উন্মোচনই মঈনুল আহসান সাহেবের ছোটগল্পের মৌল অন্বিষ্ট। শহরজীবনের ক্লেদ-স্খলন-নির্বেদ নিয়ে গল্প রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত।
স্বাধীনতা-উত্তরকালের বাংলাদেশের ছোটগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, বোধ করি এই যে, এ সময় আমাদের ছোটগাল্পিক – চেতনা হয়ে ওঠে অনেক বেশি রাজনীতিসচেতন ও জনজীবনমূল-অন্বেষী। 'সত্তর দশকের সমস্ত গল্প লেখকের গল্পের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসংবলিত কথাবস'।'২২ বস'ত, আশির দশকের গল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রেও একথা সমান প্রযোজ্য। স্বাধীনতা-উত্তরকালে পাঠকপ্রিয়তার লোভে এবং বাণিজ্যলক্ষ্মীর আরাধনায় কয়েকজন শক্তিমান গল্পকার সৃষ্টি করেছেন একটা 'জলো, অসার, বারোয়ারি কেচ্ছা' লেখার ধারা, যা ক্রমশ স্ফীতোদর হচ্ছে, ধ্বংস করছে গল্পসাহিত্যের শিল্পিত বিকাশের যাত্রাপথ। ষাটের দশকের যে আঙ্গিক-সচেতনতার সূত্রপাত, আশিতে এসে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন অনেকেই পাঠকরুচির কাছে বিসর্জন দিচ্ছেন শিল্পমানকে, বক্তব্যভুক পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্যেই তাঁরা যেন সর্বদা সচেষ্ট।
আশির গল্পকার সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল ও শক্তিমান শহীদুল জহিরের গল্পে মানুষের বেঁচে থাকার আর্তি ও সংগ্রাম নবীন মাত্রা নিয়ে উন্মোচিত হয়েছে। তাঁর সময়ের তিনি সবার্ধিক আলোড়িত। প্রেম ও ভালোবাসা এবং মানুষের অস্তিত্বের সংকট তাঁর গল্পের প্রধান বিষয়।
নব্বইয়ের গাল্পিক শাহাদুজ্জামানের গল্পে নিরীক্ষাধর্মী শিল্পজিজ্ঞাসার ছাপ স্পষ্ট। পারভেজ হোসেন, ইমতিয়ার শামীম, আহমাদ মোস-ফা কামালের গল্পেও পাই নানামাত্রিক নিরীক্ষার ছাপ। সাদ কামালী, শাহনাজ মুন্নী, সেলিম মোরশেদ, কাজল শাহনেওয়াজ, ওয়াসি আহমেদ, মশিউল আলম, রায়হান রাইন প্রমুখ গল্পকার বাংলাদেশের ছোটগল্পে শক্তিমান গাল্পিক হিসেবে ইতোমধ্যে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।

ছয়
উপর্যুক্ত আলোচনায় আমরা বাংলাদেশের ছোটগল্পের বিকাশরেখা সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বিস-ৃতির অবকাশ না-থাকার কারণে, অনেক ক্ষেত্রেই আলোচনাকে করতে হয়েছে সংক্ষিপ্ত, সেদিক থেকে পর্যবেক্ষণ করলে এ কোনো পূর্ণাঙ্গ আলোচনা বা অন-র্জরিপ নয়। এবং এ কারণেই অনেক অপ্রধান ছোটগাল্পিকের রচনা হতে পারেনি আলোচনার অন্তর্গত। বাংলাদেশের ছোটগল্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে সত্য প্রতিষ্ঠা পায় তা এই যে, আমাদের সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় ছোটগল্প দাবি করতে পারে গৌরবের আসন। তবে বর্তমান সময়ে ছোটগল্পের ক্ষেত্রে চলছে এক ধরনের বন্ধ্যত্ব। বাংলাদেশ কিংবা ভারতীয় বঙ্গ – উভয় ক্ষেত্রেই বিশুদ্ধ ছোটগাল্পিকের আবির্ভাব এখন ক্বচিৎ-কদাচিৎ। ইতিপূর্বে যাঁরা ভালো গল্প লিখেছেন, তাঁরা অনেকেই হাত গুটিয়ে নিয়েছেন, আসছেন না নবীন অনেক ছোটগাল্পিক, বিশেষ করে কয়েকজন নারী গল্প-লেখিকার মধ্যে আমরা সম্ভাবনা দেখছি। প্রবীণরা, অনেকেই, পূর্বে লেখা গল্পগুলো একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নতুন ভাষ্যে করছেন উপস্থাপন। বোঝা যায়, ফুরিয়ে গেছে তাঁদের প্রতিভার দীপ্তি।
পঞ্চাশ-ষাট-সত্তুরের দশকে ছোটগল্পের মূল বাহন পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীর অভাব ছিল প্রকট। তবু ছোটগল্প রচিত হয়েছে। বর্তমানে পত্র-পত্রিকার অভাব নেই, অভাব ভালো ছোটগল্পের। মানুষের সময়ধারণার পটভূমিতে জন্ম হয়েছিল ছোটগল্পের। সময়ের শাসন এখন ঊনবিংশ শতাব্দীর তুলনায় আরো প্রকট। তাহলে বাংলা ছোটগল্পের এই দৈন্যদশা কেন? নাকি পাঠকপ্রিয়তা ও বাণিজ্যবুদ্ধির প্রেরণায় রচিত ষাট থেকে আশি পৃষ্ঠার উপন্যাস নামের বড় গল্পগুলো বাধাগ্রস্থ করছে ছোটগল্পের বিকাশ? পাঠক-রুচির কাছে লেখক বিসর্জন দিচ্ছেন কি আপন প্রতিভা? প্রকাশক যে কাটতি না থাকলে ছোটগল্পের বই প্রকাশ করবেন না – এ কথা তো লেখাই বাহুল্য। তবু তো কথা থেকে যায় কোনো কোনো সৎ প্রকাশকের কাছে। আমরা আশা করবো, সেইসব নবীন-প্রবীণ ছোটগাল্পিক, যাঁদের ক্ষমতা আছে, তাঁরা এগিয়ে আসবেন ভালো ছোটগল্প রচনায়; সম্মিলিত সাধনায় তাঁরা আবার আনবেন বাংলাদেশের ছোটগল্পের পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের সেই স্বর্ণালি আভা, একবার, আরো একবার। তারপরও ছোটগল্পের অমিত সম্ভাবনার কথা না বললেই নয়। ছোটগল্পই হয়ে ওঠে জীবন-দর্পণ। নবীনদের ছোটগল্পে সে-প্রত্যাশারই প্রতিফলন হবে – এ আশাই ব্যক্ত করি।

তথ্যনির্দেশ
১. রথীন্দ্রনাথ রায়, ছোটগল্পের কথা (কলকাতা, ১৯৮৮), পৃ ৪৬।
২. সৈয়দ আকরম হোসেন, বাংলাদেশের সাহিত্য ও অন্যান্য প্রসঙ্গে (ঢাকা, ১৯৮৫), পৃ ১৪।
৩. রাজীব হুমায়ুন, আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ রচনা (ঢাকা, ১৯৮৫) পৃ ১২-১৯।
৪. সৈয়দ আকরম হোসেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌ (ঢাকা, ১৯৮৮), পৃ ৭৫, ৭৭।
৫. আহমদ কবির, 'স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যের রূপান-র : বিষয় ও প্রকরণ : প্রসঙ্গ – ছোটগল্প', একুশের প্রবন্ধ ৮৮ (বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৮), পৃ ৩৮।
৬. মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ), (ঢাকা ১৩৮৫), পৃ ৪৪০।
৭. অসীম সাহা, 'এ-দেশের গল্প/পূর্ণতা-অপূর্ণতা', কণ্ঠস্বর (সম্পাদক : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ), ঢাকা, দশম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, পৃ ২৭।
৮. রফিকউল্লাহ খান, 'হাসান হাফিজুর রহমানের ছোটগল্প', সাহিত্য পত্রিকা, (সম্পাদক : মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান), অষ্টাবিংশ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, ফাল্গুন ১৩৯১, পৃ ২৪১।
৯. অসীম সাহা, 'এ-দেশের গল্প/ পূর্ণতা-অপূর্ণতা', পূর্বোক্ত, পৃ ২৯।
১০. মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ), পূর্বোক্ত, পৃ ৪৪২।
১১. আহমদ কবির, 'স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যের রূপান-র : বিষয় ও প্রকরণ : প্রসঙ্গ – ছোটগল্প', পূর্বোক্ত, পৃ ৩৯।
১২. বিশ্বজিৎ ঘোষ, বাংলাদেশের সাহিত্য (ঢাকা, ১৯৯২), পৃ ১৪-১৫।
১৩. আহমদ কবির, 'স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যের রূপান-র : বিষয় ও প্রকরণ : প্রসঙ্গ – ছোটগল্প', পূর্বোক্ত, পৃ ৪৭।
১৪. অসীম সাহা, 'এ-দেশের গল্প/ পূর্ণতা-অপূর্ণতা', পূর্বোক্ত, পৃ ৩২।
১৫. অশ্রুকুমার সিকদার, নবীন যদুর বংশ (কলকাতা, ১৯৯১), পৃ ৪৭।
১৬. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৭-১৪৮।
১৭. আবু জাফর, গল্পকার হাসান আজিজুল হক (ঢাকা, ১৯৮৮), পৃ ১০।
১৮. সুশান- মজুমদার, 'আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : দ্বৈরথ সময়', আজকের কাগজ, ঢাকা, ১৯৯১।
১৯. সালাম সালেহ্‌উদ্দীন (সম্পাদক), অরুন্ধতী, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, জুলাই ১৯৯১, ঢাকা, পৃ ৩৫।
২০. কায়েস আহমেদ, 'নিজের সঙ্গে আলাপ', অরুন্ধতী, পূর্বোক্ত, পৃ ২১।
২১. সুশান- মজুমদার, 'ষাটের উত্তরাধিকার : সত্তের গল্প', অরুন্ধতী, পূর্বোক্ত, পৃ ২৯।
২২. পূর্বোক্ত, পৃ ২৮।

Palash Biswas
Pl Read:
http://nandigramunited-banga.blogspot.com/

No comments:

LinkWithin

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...